ধর্মঘটে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা, ‘বিড়ালের চেয়েও বড় ইঁদুর’ ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের রাস্তায়

উইল টিমস খুব ব্যস্ত মানুষ। পেস্ট কন্ট্রোলার হিসেবে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামে কাজ করছেন তিনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইঁদুর, তেলাপোকা ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় প্রাণী নির্মূল করেন।
সম্প্রতি টিমসের ফোনটি বন্ধ হওয়ার সময় পাচ্ছে না। কারণ বার্মিংহামের রাস্তায় প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য জমে আছে।
টিমস সিএনএনকে বলেন, "গন্ধটা একেবারে অস্বাভাবিক। এসব আবর্জনায় থলে ভর্তি পচা খাবার এবং আশেপাশে এসবের গন্ধে পোকা-মাকড় এসে পড়েছে।"
শহরে যেখানে যেখানে এমনভাবে আবর্জনা পড়ে থাকার কারণ হলো, বার্মিংহামের ময়লা সংগ্রহকারীরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন। যার কারণে ১.২ মিলিয়ন বাসিন্দার অনেকেরই বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়নি। যার কারণে কিছু কিছু জায়গায় বর্জ্যের স্তূপ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যার আকৃতি কয়েক ফুট উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে ইদুর ও মশা গর্ত করে বসবাস করছে।
টিমস এ পরিস্থিতির বর্ণনা করে বলেন, "এসব ইদুর-মশার জন্য এগুলো হলো পাঁচ তারকা হোটেলে পরিণত হয়েছে।"
টিমসের ব্যবসা খুব ভালো চলছে। আর ব্যবসা এতটাই ভালো চলছে যে তিনি সব কাজ একা করতে পারছেন না। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাজ দিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি জানান, ময়লা সংগ্রহকারীরা ধর্মঘটে যাওয়ার কারণে মানুষের বাসা বাড়িতে ইদুরের উপদ্রব হয়েছে। তিনি ৫০ শতাংশ ডাক পান ইদুর তাড়ানোর জন্য।
বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির শহর ডিকেন্সিয়ানের চিত্র এটি। একটা সময় এ শহর ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। তবে দুই বছরেরও কম সময় আগে শহরটি নিজেদের মূলত দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।
বালসাল হিথে বসবাসকারী এক পথচারী সিএনএনকে বলেন, "এখানে সব জায়গায় আবর্জনা, সব জায়গায় ইদুর। বিড়ালের থেকেও বড়। এটা ব্রিটেন। এটা ২০২৫। কী হচ্ছে এসব?"
তার এ প্রশ্নের উত্তর হলো: প্রায় ৪০০ ময়লা সংগ্রহকারী ধর্মঘট পালন করছেন। সরকারের সিদ্ধান্তে তাদের একটি নির্দিষ্ট পদ বাতিল করা হয়েছে। কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনাইট ইউনিয়ন দাবি করছে, এই পদক্ষেপটি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির পথ বন্ধ করে দিয়েছে এবং কিছু কর্মীকে পদমর্যাদাহীন করে দিয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বছরে তাদের ১০ হাজার ৩৯০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বেতন কমে যেতে পারে।
বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল এই পরিসংখ্যানটি অস্বীকার করে এবং বলে, এটি প্রভাবিত কর্মীদের জন্য বিকল্প ভূমিকা এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের সুযোগ প্রস্তাব করেছে। তাদের ওয়েবসাইটে কাউন্সিল উল্লেখ করেছে, "কোনো কর্মীকে কোনো টাকা হারাতে হবে না এবং এই পরিবর্তনগুলো তাদের লক্ষ্য আর্থিকভাবে টেকসই হওয়া এবং এর বর্জ্য সংগ্রহ সেবা আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।"
এ চলমান বিরোধ চতুর্থ মাসে গড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। প্রথমে বিরতি দিয়ে ধর্মঘট পালন করা হয়েছে। কিন্তু মার্চ থেকে এ ধর্মঘট অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও শহরে এখনো কিছু বর্জ্য সংগ্রহকারীরা কাজ করছেন। কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, শহরে এখন অর্ধেকেরও কম বর্জ্যের ট্রাক চলছে।
সরেজমিনে গিয়ে সিএনএন দেখে, কিছু এলাকা অন্য এলাকাগুলো থেকে বেশি নোংরা ছিল।
সোমবার সিটি কাউন্সিল বর্জ্যের স্তুপ এবং এর দ্বারা সৃষ্ট স্বাস্থ্যের ঝুঁকিকে একটি 'বড় ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করেছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্য শহর থেকে অতিরিক্ত বর্জ্য সংগ্রহকারী ট্রাক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়। তবে কাউন্সিল জানায়, প্রতিবাদকারীরা বর্জ্য ডিপো থেকে ট্রাক বের হতে বাধা দিয়েছে, যার ফলে কম বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
ইউনাইটের প্রধান কর্মকর্তা ওনাই কাসাব সিএনএনকে বলেন, "এটা একটি বিপজ্জনক কাজ। এটি অত্যন্ত শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং কাজ। তাই মানুষদের এটির জন্য সঠিকভাবে পুরস্কৃত হওয়া উচিত।"
আর্থিক অবস্থার ভগ্নদশা
ব্রিটিশ আমলের ক্রাইম নিয়ে তৈরি সিরিজ 'পিকি ব্লাইন্ডারস' ১৯২০-এর দশকের অপরাধ গ্যাংয়ের কাহিনী ফুটে উঠেছিল। সিরিজটির কারণে বার্মিংহাম কিছুটা পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত হয়। পুরোনা মর্যাদা কিছুটা ফিরে পায়।
তারপরও বার্মিংহামের সংগ্রাম অব্যাহত আছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির পরিচালিত বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল ১১৪ ধারার একটি নোটিশ দাখিল করেছে। এটি একটি আইনি পদক্ষেপ যা মূলত স্থানীয় সরকারকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, শিক্ষা এবং বর্জ্য সংগ্রহের মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো ছাড়া সমস্ত খরচ বন্ধ করে দেয়।
বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল দীর্ঘদিনের সমান বেতনের বিরোধের কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কাউন্সিলকে সাবেক কর্মীদের বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ বেশিরভাগ নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পান।
তবে সমান বেতনের অধিকার ছাড়াও কাউন্সিলের নিজস্ব ভুলেও কারণে তারা আর্থিক চাপে পড়েছে।
ব্রামি হিসেবে পরিচিত বার্মিংহামের বাসিন্দারা দীর্ঘজীবী হওয়ায় তাদের সেবা গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে খরচও বেড়েছে। তবে এমন অবস্থা শুধু বার্মিংহামের নয়। অন্যান্য শহরের স্থানীয় সরকাররা একই সমস্যার মধ্যে রয়েছে।
ব্রিটেনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো তাদের তহবিলের একটি বড় অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে গ্রান্ট হিসেবে পেয়ে থাকে। তবে, ২০১০ সালের পর থেকে এই গ্রান্টের পরিমাণ কমে গেছে। কারণ তৎকালীন সাবেক কনজারভেটিভ সরকার আর্থিক সংকটের পর দেশের ঋণ কমানোর জন্য দশ বছরের এক্সেসিভ কাটছাঁট নীতি চালু করেছিল।
ইংল্যান্ডে, কাউন্সিলগুলোতে বাসিন্দা প্রতি তহবিল (গ্রান্ট এবং স্থানীয় কর সহ) ২০১০ সালের তুলনায় গড়ে ১৮ শতাংশ কমে গেছে। এটি ২০২৪ সালের জুনে ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বার্মিংহামের দুর্দশা টিমসের মতো পেস্ট কন্ট্রোলারদের উপর ভারী প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, "আমি বিষয়টি নিয়ে রাগান্বিত। এটা সবার স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে।"