সবসময় ক্লান্ত? এর পেছনে আছে আশ্চর্যজনক কারণ!

প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরও কি দিন শেষে ক্লান্তি অনুভব করেন? এর পেছনে থাকতে পারে অপ্রত্যাশিত, তবে সাধারণ একটি কারণ—ইমোশনাল লেবার বা আবেগজনিত মানসিক শ্রম। বিশেষ করে, আপনি যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক বা এর নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে হয়তো অজান্তেই কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিচ্ছেন।
এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী শ্যানন সাউর-জাভালা একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন সাইকোলজি টুডে-এর এক লেখায়। তিনি দেখিয়েছেন, অতিরিক্ত ইমোশনাল লেবার আমাদের শারীরিক শ্রম ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্ত করে তুলতে পারে। তার মতে, এটি অনেকেরই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা অবসাদের অন্যতম কারণ হতে পারে।
ইমোশনাল লেবার কী?
ইমোশনাল লেবারের সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দেওয়া হলেও মূল বিষয় একটাই—অন্যের মানসিক স্বস্তি নিশ্চিত করার জন্য নিজের অতিরিক্ত মানসিক শ্রম। এটি শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও ঘটে।
অনেক সময় আমরা নিজের সত্যিকারের অনুভূতি লুকিয়ে হাসিমুখ ধরে রাখি, যাতে পরিবেশ ভারী না হয়। অফিসে হয়তো আপনিই সেই ব্যক্তি, যিনি নিশ্চিত করেন যে সহকর্মীদের জন্মদিন বা বিশেষ দিনগুলো যথাযথভাবে উদযাপিত হচ্ছে। কর্মীদের বা ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের নিয়ে আড্ডার আয়োজনও হয়তো আপনিই করেন। আবার যখন সহকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন পরিস্থিতি শান্ত রাখার দায়িত্বও এসে পড়ে আপনার ওপর।
একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়িক নেতা হিসেবে কর্মীদের মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সবসময় অন্যদের আবেগের ভার বহন করতে গিয়ে যদি নিজের মানসিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে তা শুধু আপনার জন্যই নয়, বরং আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত ইমোশনাল লেবার একসময় আপনাকে ক্লান্ত করে তুলবে এবং আপনার কর্মদক্ষতাও কমিয়ে দিতে পারে।
সাওয়ার-জাভালা কিছু উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ইমোশনাল লেবার আসলে কী ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে—পরিবার, কর্মক্ষেত্র বা বন্ধুমহলে সব পরিকল্পনার দায়িত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের কাঁধে নিয়ে নেওয়া কিংবা এমনকি ক্লান্ত থাকলেও সবার 'থেরাপিস্ট বন্ধু' হয়ে থাকা। যদি প্রায়ই অকারণে অবসাদ অনুভব করেন, তবে এর অন্যতম কারণ হতে পারে অতিরিক্ত ইমোশনাল লেবার।
ভালো খবর হলো, আপনি চাইলে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
নিজের ইমোশনাল লেবার সম্পর্কে সচেতন হোন
আমাদের অনেকের জন্যই এটি এতটাই স্বাভাবিক একটি অভ্যাস যে, আমরা বুঝতেই পারি না যে এটা আমাদের ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতিবার অন্যের সমস্যা শুনে সান্ত্বনা দেওয়ার আগে আমরা খুব কমই নিজেদের শক্তি বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবি।
সাওয়ার-জাভালা প্রশ্ন তুলেছেন—আপনি কি সবসময় বন্ধুদের খোঁজ রাখেন, কিন্তু কেউই আপনার খবর নেয় না? তার মতে, সচেতন হওয়াই প্রথম ধাপ।
ইমোশনাল লেবারের সীমারেখা নির্ধারণ করুন
সাওয়ার-জাভালা পরামর্শ দেন, নিজের সীমাবদ্ধতাকে সম্মান জানানো শুরু করুন। কারও আবেগগত সমস্যা সামাল দিতে গিয়ে যদি দেখেন আপনার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তাহলে স্পষ্ট করে বলুন—'আমি এই মুহূর্তে এটা নিতে পারছি না।'
এছাড়া, নিজের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করাও জরুরি। যেমন, যদি রাত ৮টায় অফিসের কোনো সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু তা জরুরি না হয়, তাহলে সেটি পরদিন সকালে দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ। একইভাবে, অফিসের পার্টির পরিকল্পনা করা বা সহকর্মীদের মধ্যকার কোনো বিবাদের সমাধান করা—এসব কাজ যদি রাতের সময় এসে পড়ে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে পরদিন সকালে দেখার সিদ্ধান্ত নিন। এতে আপনার মানসিক বিশ্রাম নিশ্চিত হবে, এবং পরদিন আপনি আরও সতেজ হয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
এমন কিছু করুন যা আপনাকে মানসিকভাবে শক্তি দেয়
এমন কিছু কাজ করুন যা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সহায়ক, যেমন জার্নাল লেখা বা মেডিটেশন করা—এগুলোর প্রমাণিত সুফল রয়েছে। সাওয়ার-জাভালা এগুলোকে 'গভীর বিশ্রামমূলক কার্যক্রম' বলে উল্লেখ করেছেন।
আপনি প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটিয়ে বা এমন বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলে যারা আপনাকে ভালোভাবে বুঝে এবং পুরোপুরি সমর্থন দেয়, মানসিক শক্তি ফিরে পেতে পারেন। এমন কার্যক্রমে সময় দেওয়া ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ঘুম এবং ব্যায়ামে সময় দেওয়া। এগুলোকে আপনার সুস্থ থাকার রুটিনের অংশ হিসেবে মনে করুন।
এছাড়া, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে—এটা হয়তো কিছুটা অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: নিজেকে কিছু অবিন্যস্ত সময় দিন, যখন আপনার কোনো কাজ বা লক্ষ্য থাকবে না।
সাওয়ার-জাভালা লিখেছেন, 'যদি প্রতিটি অবসর মুহূর্ত বাধ্যবাধকতা, কাজ বা অযথা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর দ্বারা পূর্ণ হয়ে থাকে, আপনার মস্তিষ্ক কখনোই বিশ্রাম পাবে না।' জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই নিজেকে এমন কিছু সময় দিন, যেখানে আপনি শুধু ভাবতে পারেন, বিশ্রাম নিতে পারেন, বা কিছু না করে থাকতে পারেন। এতে আপনি অনেক বেশি বিশ্রাম পাবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ মানসিক কাজগুলো আরও ভালোভাবে করতে পারবেন।