খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে ১৭ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১.৭৭ লাখ কোটি টাকা

খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধিতে প্রভিশন সংরক্ষণে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ 'ক্লাসিফায়েড লোন অ্যান্ড প্রভিশনিং' প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকায়, যেখানে তিন মাস আগেও [ডিসেম্বর ২০২৪] এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
এই তিন মাসেই নতুন করে সাতটি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়েছে, যাদের সম্মিলিত ঘাটতি ৪১ হাজার কোটি টাকা। এখন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ১৭টি।
ব্যাংকঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়, যাকে প্রভিশন বলা হয়। এই প্রভিশন নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম হলে যে ঘাটতির সৃষ্টি হয়, সেটিই প্রভিশন ঘাটতি।
নতুন করে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়া সাতটি ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। তবে একই সময়ে সোনালী ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির তালিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে বর্তমানে চারটি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ১০ হাজার ৩১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৭ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের ৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক, যার ঘাটতি ২১ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক ১৮ হাজার ৯১৮ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ১৬ হাজার ৪৭৭ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ১৫ হাজার ২৭১ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ১৪ হাজার ২৬৪ কোটি এবং সোসিয়াল ইসলামী ব্যাংক ১০ হাজার ৫৭১ কোটি টাকার ঘাটতিতে।
এছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৭ হাজার ১৭ কোটি, ইউসিবি'র ২ হাজার ৬৪৩ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকের ৭১৭ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৮৫ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৫৭৫ কোটি, এনআরবি ব্যাংকের ৫৪৩ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৫১২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চাপ
এদিকে, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বেশি।
এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে নতুন ঋণ শ্রেণিকরণের কড়া নির্দেশনা এবং কিছু বড় ঋণ অ্যাকাউন্টের [হিসাব] অবস্থার অবনতি দায়ী।
বর্তমানে মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশই শ্রেণিকৃত, অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর দেওয়া প্রতিটি চারটি ঋণের মধ্যে একটি খেলাপি। এর মধ্যে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা 'ব্যাড লোন' [খারাপ ঋণ] হিসেবে চিহ্নিত, যা মোট শ্রেণিকৃত ঋণের ৮১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এই ঋণগুলো অনাদায়ী এবং ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকায় ব্যাংকের কার্যকর মূলধন ও ঋণ বিতরণের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর লাভজনকতা ও মূলধন—দুটিই কমে যাচ্ছে, যা ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়েসি রেশিও কমিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে নিট মুনাফা থেকেই এই ঘাটতি মেটাতে হবে, ফলে অনেক ব্যাংক হয়তো বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিতে পারবে না। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে রিকভারি প্রসেস (পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া) আরও জোরদার করতে হবে এবং মামলা নিষ্পত্তির সময় কমাতে বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকের প্রভিশনিংয়ের চাপ তাদের তরল অর্থের ঘাটতি তৈরি করছে। এতে করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া এবং নতুন ঋণ প্রদানের সক্ষমতা—দুই দিকেই প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত ব্যাংকগুলোকে আমানতের শূন্য দশমিক ৫ শূন্য থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। তবে যখন ঋণ শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে, তখন এই হার বেড়ে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যা ব্যাংকের আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। যেকোনো প্রকার সংস্কারের আগে খেলাপি ঋণের উৎস চিহ্নিত করে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই প্রণোদনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন তারা।