কেন অধিকাংশ ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট লাল লিপস্টিক পরেন?

একসময় এয়ারলাইনের সাজসজ্জা নীতিমালার কড়াকড়ির অন্যতম অংশ ছিল উজ্জ্বল লাল লিপস্টিক। নিয়ম-কানুনে কিছুটা শিথিলতা আসলেও, এখনও এয়ারলাইনসের অনেক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের ঠোটে লাল লিপস্টিক দেখা যায়।
বেশিরভাগ যাত্রীই ভ্রমণের সময় ঢিলেঢালা বা আরামদায়ক পোশাক পরেন। ব্যতিক্রম শুধু এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা। তাদের সবার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, ঝকঝকে ইউনিফর্ম এবং অনেকে গাঢ় লাল লিপস্টিক পরে থাকেন, যা ট্রান্সআটলান্টিক ফ্লাইট এমনকি পৃথিবীর শেষ দিনেও টিকে থাকবে বলে মনে হয়।
কেন এমনটা করা হয়
হেদার পুল ২০ বছর ধরে একটি প্রখ্যাত মার্কিন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি তার বই 'ক্রুসিং অ্যাটিচিউড: টেলস অব ক্রাশপ্যাডস,ক্রু ড্রামা, অ্যান্ড ক্রেজি প্যাসেঞ্জারস অ্যাট থার্টি ফাইভ থাউজেন্ড ফিট'-বইতে লিখেছেন, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের প্রশিক্ষণকালে তাদের বলা হয়েছিল, 'যাতে যাত্রীরা জরুরি অবস্থায় আপনার ঠোঁট পড়তে পারে'। এটি তখন তার কাছে অদ্ভুত মনে হলেও, পরে তিনি বুঝতে পারেন যে এটি একটি কার্যকরী নিরাপত্তা ব্যবস্থা।'
তিনি লিখেছেন, 'এটি সবসময় পরা আবশ্যক ছিল। লিপস্টিক ছিল একটি সিরিয়াস বিষয়।'
এই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের রহস্যের গভীরে পৌঁছাতে, আমি দুইজন বর্তমান ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম যে তাদের লিপস্টিক পড়ার আসল অর্থ কী, এটি কি বাধ্যতামূলক এবং ইন-ফ্লাইট স্টাইলের উচ্চাকাঙ্ক্ষী জগতে এর উপযোগীতা কী।
ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টরা প্রায়ই কেন লাল লিপস্টিক পরেন?
এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ডদের লাল লিপস্টিক পরিধান শুধুমাত্র ফ্যাশনের অংশ নয়; এর পেছনে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাজনিত কারণ।
একটি জরুরি পরিস্থিতিতে, উচ্চ শব্দের মধ্যে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের নির্দেশনা শোনা কঠিন হতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লাল লিপস্টিক এই ননভার্বাল যোগাযোগে সহায়তা করে, যা যাত্রীদের নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।
এছাড়াও, লাল লিপস্টিক একটি মানসিক প্রভাবও ফেলে। এটি কর্তৃত্ব ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে কাজ করে, যা যাত্রীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সহায়ক।
এটি কি এখনও প্রচলিত আছে?
প্রতিটি প্রধান মার্কিন এয়ারলাইন্সের জন্য কাজ করা অভিজ্ঞ ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট সিডনি অ্যানিস্টিন বলেছেন, সময় বদলেছে। আমাকে কখনো এটা করতে [লাল লিপস্টিক পরতে] বলা হয়নি এবং আমি কখনো শুনিনি অন্য কোনো ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টকে এই কারণে লিপস্টিক পরতে বলা হয়েছে। আজকাল, যদি কেউ উজ্জ্বল লিপস্টিক পরেন, তা শুধুমাত্র তার নিজস্ব স্টাইলের কারণে পরে।'
অভিজ্ঞ ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট এবং ভ্রমণ লেখক ক্রিস্টিন একস্টেইন-নিজকা সিডনি অ্যানিস্টিনের কথার সঙ্গে একমত।
তিনি বলেন, ''ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা উজ্জ্বল লিপস্টিক পরেন প্রধানত 'টিপিক্যাল' ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট লুকের জন্য।"
তিনি আরও বলেন,"কিছু এয়ারলাইন্সে- যেমন এমিরেটস; লাল লিপস্টিক ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে পরিধান করা হয়।
এমিরেটসের একটি নির্দিষ্ট মেকআপ লুক রয়েছে, যা ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের মেনে চলতে হয়। এমনকি তারা মেকআপ প্রশিক্ষণও দেয়।"
তবে, সব এয়ারলাইন্সে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। যেমন- তুর্কিশ এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের লাল লিপস্টিক পরিধানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা কর্মীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক এয়ারলাইন্স তাদের ইউনিফর্ম নীতিমালা পরিবর্তন করেছে, যাতে কর্মীদের আরামদায়কতা এবং বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে লাল লিপস্টিক পরা এখনও অনেক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এমিরেটসের মতো কিছু এয়ারলাইন্সে লাল লিপস্টিক ইউনিফর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাদের পরিচিতি এবং পেশাদারিত্বের প্রতীক।
এটি শুধুমাত্র একটি সৌন্দর্যবর্ধক উপাদান নয়, বরং ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের আত্মবিশ্বাস এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবেও কাজ করে।
জরুরি পরিস্থিতিতে লাল লিপস্টিকের ভূমিকা
যদি বিমানে কোনো জরুরি পরিস্থিতি ঘটে, তাহলে যাত্রীরা হয়তো কেবিন ক্রুর নির্দেশনা শুনতে না পেরে তাদের মুখের অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করতে পারে। এক্ষেত্রে, উজ্জ্বল লাল লিপস্টিক কেবিন ক্রুর অঙ্গভঙ্গি স্পষ্টভাবে দেখাতে সহায়ক হতে পারে, যা যাত্রীদের দ্রুত ও সঠিকভাবে নির্দেশনা অনুসরণে সাহায্য করে।
এছাড়া, লাল লিপস্টিক কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবেও কাজ করে। এটি যাত্রীদের কাছে সংকেত দেয় যে, কেবিন ক্রু পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আছেন এবং তারা সঠিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম।
লাল লিপস্টিকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বেশিরভাগ বিমান সংস্থার ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের জন্য পোশাকের নিয়ম আছে। কিন্তু এয়ার ট্র্যাভেলের সোনালী যুগে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে নিয়মগুলো অনেক বেশি কঠোর ছিল।
উদাহরণস্বরূপ-বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হওয়া প্যান আম শুধুমাত্র তরুণী, 'সুন্দরী' নারীদের 'স্টুয়ার্টেস' হিসেবে নিয়োগ দিতো। এসময় স্টুয়ার্টেসদের অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী মেনে চলতে হতো। এর মধ্যে তাদের জন্য নির্ধারিত ওজনের মানদণ্ড থেকে শুরু করে লিপস্টিকের রঙ পর্যন্ত সব ছিল নির্ধারিত।
একটি ভাইরাল সামাজিক মিডিয়া পোস্ট অনুযায়ী, ১৯৬৪ সালে প্যান আমের একটি ক্রুর সদস্য অ্যানে সুইনি একবার একটি সংবাদপত্রে বলেছিলেন: 'রেভলন আমাদের মেকআপ পরিচালনা করত এবং আমাদের পার্সিয়ান মেলন লিপস্টিক এবং এর সঙ্গে মানানসই নেইল পলিশ পরা বাধ্যতামূলক ছিল।
ওই নারী বলেন, পার্সিয়ান মেলন ঠোটে লাগানোর পর আমার মুখটা মৃতদেহের মতো লাগছিল। তাই কিছুটা ভিন্ন রঙের লিপস্টিক পরার জন্য সৌন্দর্য প্রশিক্ষক থেকে আমার লিখিত অনুমতি নিতে হয়েছিল।'
বিশেষ করে যখন আপনি শিখেন যে পার্সিয়ান মেলন একটি অত্যন্ত '৬০' সালের উজ্জ্বল গোলাপী—নিশ্চিতভাবে একটি সর্বজনীনভাবে দারুণ রঙ নয়।
এই কঠোর নিয়মাবলী ছিল বিমানের ব্র্যান্ড ইমেজ বজায় রাখার জন্য। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব নিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে, কিছু এয়ারলাইন্স এখনও তাদের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের জন্য নির্দিষ্ট সৌন্দর্য মানদণ্ড বজায় রেখেছে।
যেমন- কাতার এয়ারওয়েজ তাদের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের জন্য নির্দিষ্ট মেকআপ এবং পোশাকের নিয়মাবলী অনুসরণ করে।
বর্তমানে অনেক এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের জন্য সৌন্দর্য মানদণ্ডে নমনীয়তা প্রদানের মাধ্যমে বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করছে।
তবে, কিছু এয়ারলাইন্স এখনও তাদের ব্র্যান্ড ইমেজ বজায় রাখতে নির্দিষ্ট সৌন্দর্য মানদণ্ড অনুসরণ করে।