ট্রাম্পের ইউক্রেন বিরাগে ইউক্রেনের সঙ্গে ইউরোপও একা!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপীয় নেতারা তাকে ইউক্রেন ইস্যুতে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিচ্ছেন।
কিন্তু শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে উত্তপ্ত বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতারা বুঝতে পারেন, এখনই কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। বৈঠকের একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প আকস্মিকভাবে জেলেনস্কির সঙ্গে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করেন এবং সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছে, ততক্ষণ জেলেনস্কি 'শান্তির জন্য প্রস্তুত নন'।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কোনো শান্তিচুক্তি না মানলে ইউক্রেনকে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন যে, তার পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগত ইউরোপীয় মিত্রদের দিক থেকে সরে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে।
জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টেইনমায়ার একে 'হতবাক করার মতো ঘটনা' বলে মন্তব্য করেছেন। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডিপিএ-কে তিনি বলেন, 'গতকালের হোয়াইট হাউসের দৃশ্য দেখে আমি স্তম্ভিত। কখনো ভাবিনি যে, আমাদের ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও রক্ষা করতে হবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত এই নাটকীয় পরিবর্তনে ইউরোপীয় নেতারা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, ইউক্রেনের জন্য দুর্বল কোনো শান্তিচুক্তি হলে তা রাশিয়াকে আরও উৎসাহিত করবে এবং ইউরোপের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে ইউরোপের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অর্জন এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
সঠিক সামরিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে ইউরোপের কয়েক বছর সময় লাগবে। এর মধ্যেই ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া এবং নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় নেতারা ইতোমধ্যেই ভাবছিলেন, শান্তিচুক্তি হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, কী ধরনের শর্ত তারা মেনে নেবেন এবং নতুন সহায়তা প্যাকেজে কী অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এই আলোচনার অংশ হিসেবে শীর্ষ কর্মকর্তারা এই সপ্তাহেই বৈঠকে বসবেন। আজ রোববার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের উদ্যোগে লন্ডনে এবং আগামী বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের বিশেষ সম্মেলনে ইইউ নেতারা একত্র হবেন।
শুক্রবার ইইউর ২৭টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা আসন্ন ব্রাসেলস সম্মেলনের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এতে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দ্রুত শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয় এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়টি আরও সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণের প্রস্তাব আসে। তবে এটি ছিল ট্রাম্প-জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের আগের আলোচনা।
বৈঠকের পর ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপীয় নেতাদের প্রকাশ্য সমর্থন আরও দৃঢ় হয়। শুক্রবার রাতে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ ইউরোপীয় নেতাদের যৌথ বার্তা দিয়ে লিখেন, 'আপনি কখনো একা নন, প্রিয় প্রেসিডেন্ট।'
একই সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও ওঠে। কিছু ইউরোপীয় কূটনীতিক ও নেতা আশা করছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে এখনো যারা অনীহা দেখাচ্ছেন, তারা এবার আরও উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপে রাজি হবেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'শক্তিশালী ইউরোপের প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এটি গড়ে তুলতে হবে এখনই।'
তবে এমন সাহসী ঘোষণা দেওয়া যতটা সহজ, বাস্তবে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর কাজ ততটাই কঠিন।
প্রথমত, ইউক্রেনের জন্য বাড়তি আর্থিক দায়ভার নেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল হতে পারে। গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র একাই ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সহায়তা হিসেবে প্রায় ১১৪ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যেখানে ইউরোপের সহায়তার পরিমাণ ১৩২ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া, সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের গভীর প্রভাব রয়েছে। দেশটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ব্যবস্থা ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এই পুরো ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তোলা ইউরোপের একার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
গত কয়েক বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। তবে এখনো কিছু ন্যাটো সদস্য দেশ তাদের জিডিপির অন্তত ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।
এদিকে প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করলে স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমাতে হতে পারে। জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফলে সামরিক ব্যয় বাড়ানোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুঁজে পাওয়াটাও কঠিন হয়ে উঠছে।
তবে ইউরোপীয় নেতারা প্রতিরক্ষা বিনিয়োগ বাড়াতে ব্লকের ঘাটতি সংক্রান্ত নিয়ম শিথিল করার উপায় খুঁজছেন।
তবে ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য নেই।
এর আগে ইউক্রেনের জন্য কয়েক বিলিয়ন ইউরোর নতুন সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা চলছিল। শুক্রবার রাতে কিছু দেশ এই বিশাল সহায়তা পরিকল্পনার পক্ষে আরও জোরালো অবস্থান নেয়। আশা করা হচ্ছিল, ট্রাম্পের কঠোর মনোভাব ইউক্রেন ইস্যুতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে।
এদিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ইউরোপের বেশিরভাগ নেতার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'তিনি সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, যদিও এটি অনেকের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন।'
ফলে ধারণা করা হচ্ছে, হাঙ্গেরি এই সহায়তা প্যাকেজের বিরোধিতা করতে পারে। ফলে ইইউকে একক প্যাকেজ অনুমোদনের পরিবর্তে সদস্য দেশগুলোর স্বতন্ত্র সহায়তার পথে হাঁটতে হতে পারে। এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, কারণ ইইউর সম্মিলিত সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদনের জন্য সব সদস্য দেশের সম্মতি প্রয়োজন।
এদিকে ইউক্রেনে ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা চলছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে, কখন ও কীভাবে ইউরোপীয় সেনা মোতায়েন করা হবে, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর আগ্রহ দেখিয়েছে।
তবে শুক্রবারের ঘটনার পর অনেকেই মনে করছেন, দীর্ঘ আলোচনার সময় হয়তো শেষ হয়ে এসেছে। ওভাল অফিসে উত্তপ্ত বৈঠকের পর ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের এখন কূটনৈতিক দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে চেষ্টা করতে হবে, যেন যুক্তরাষ্ট্রকে অন্তত কিছুটা হলেও ইউক্রেন ইস্যুতে পাশে রাখা যায়।
ইউরোপে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি সকল মিত্রদের নিয়ে একটি বৈঠকের উদ্যোগ নেবেন।
তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলো ও মিত্রদের মধ্যে অবিলম্বে একটি সম্মেলন হওয়া জরুরি, যেখানে আমরা খোলামেলা আলোচনা করতে পারব যে, বর্তমানের বড় চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করব। প্রথমত, ইউক্রেন ইস্যু দিয়ে শুরু করা দরকার।'
গত সপ্তাহের শুরুতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। যদিও তাঁরা শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আদায় করতে ব্যর্থ হন, তবু এসব বৈঠকের পরিবেশ 'ট্রাম্প-জেলেনস্কি' বৈঠকের তুলনায় তুলনামূলক ভালো ছিল।
তবে ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রমশ বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন 'অত্যন্ত অনির্ভরযোগ্য অংশীদার' হয়ে উঠেছে।
ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুগেলের পরিচালক জেরোমিন জেটেলমেয়ার বলেছেন, 'এখন ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখার এবং সম্পর্ক আগের মতো থাকবে বলে আশা করার সময় হয়তো শেষ হয়ে এসেছে।'