ইউক্রেন চায় ‘যুদ্ধবিরতি’, পুতিন ও ট্রাম্প চান ‘শান্তি চুক্তি’: বিরোধ মূলত এখানেই

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির দাবির অবস্থান থেকে সরে এসে এখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্থায়ী শান্তি চুক্তির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছেন। তবে এর পরও কিছু ইউরোপীয় নেতা অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে চাপ দিচ্ছেন, যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করছেন এর 'প্রয়োজন নেই'।
এর মানে এই নয় যে কিয়েভ ও তার মিত্ররা শান্তি চায় না। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে, রাশিয়া যে ধরনের চুক্তি চাইছে তা সম্ভব নয়। কারণ বৈশ্বিক নীতি অনুসারে কোনো দেশ জোরপূর্বক কোনো জায়গা দখল করতে পারবে না। দখল করতে চাইলে সেই নীতি ভাঙতে হবে।
আর কিয়েভের ইউরোপীয় মিত্ররা সেই ঝুঁকি নিতে চান না। কারণ তারা নিজেরাই রাশিয়ার আগ্রাসনের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে।
সোমবার ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং কয়েকজন ইউরোপীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ট্রাম্প। আবার তিনি মস্কোর কিছু বক্তব্যের সঙ্গেও সুর মিলিয়েছেন। তাই ট্রাম্প প্রশ্নে তোলেন, যদি একটি বৃহত্তর শান্তি চুক্তি করা সম্ভব হয়, তাহলে যুদ্ধবিরতির আদৌ 'প্রয়োজনীয়' কি না।
কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে ভূমি ছেড়ে দেওয়া জাতিসংঘ সনদের অধীনে সম্পূর্ণ অবৈধ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই সনদে সাক্ষর করেছে।
শান্তি চুক্তি ও যুদ্ধবিরতি প্রায়ই একই জিনিস মনে করা হলেও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ দুটির মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে লড়াইরত পক্ষগুলোকে লড়াই থামাতে হবে। তবে প্রত্যেকেই তাদের দখলে থাকা এলাকা ধরে রাখে। তবে এর মূল উদ্দেশ্য অস্থায়ী বিরতি—যাতে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো যায় বা সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।

কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা প্রস্তাব করেছে যে যুদ্ধবিরতি হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ, যার পর জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হতে পারে। এর পর ট্রাম্প, জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের সম্ভাবনাও রয়েছে।
সোমবার অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না যে যুদ্ধবিরতি ছাড়া পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
যুদ্ধবিরতি খুব সংক্ষিপ্তও হতে পারে—যেমন ১৯১৪ সালের ক্রিসমাস ট্রুস মাত্র কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী হয়েছিল—আবার তা কয়েক দশক পর্যন্তও গড়াতে পারে। যেমন সাইপ্রাস ও তুরস্কের মধ্যে, এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কয়েক দশক ধরে চলছে, কিন্তু কোনো স্থায়ী শান্তি চুক্তি হয়নি।
কিন্তু পুতিন যা চান—এবং এখন স্পষ্টতই ট্রাম্পও তাই চান—তা হলো একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি।
আন্তর্জাতিক আইনে শান্তি চুক্তি বলতে বোঝানো হয় একটি আনুষ্ঠানিক ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যা দুটি দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।
জটিলতাটা এখানেই।
গ্লোবাল রাইটস কমপ্লায়েন্স নামের মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের আইনি উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী জেরেমি পিজি বলেন, 'আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূলনীতি জাতিসংঘ সনদে স্পষ্টভাবে লেখা আছে: বলপ্রয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর মানে হলো, যে কোনো চুক্তি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আদায় করা হলে তা কার্যত অবৈধ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিলযোগ্য।'
পুতিন গত সপ্তাহে ট্রাম্পের সঙ্গে যে শান্তি চুক্তির আলোচনা করেছেন, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। তবে এটা পরিষ্কার যে রুশ প্রেসিডেন্ট তার বড় ধরনের দাবি থেকে সরে আসেননি। এর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনকে পূর্বাঞ্চলের পুরো দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল (যা সম্মিলিতভাবে দনবাস নামে পরিচিত) ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে ন্যাটোতে যোগদানে নিষিদ্ধ করা।
এ ধরনের চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হবে: প্রথমত, এটি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে বলে অবৈধ এবং দ্বিতীয়ত, এর শর্তগুলো আন্তর্জাতিক নীতির বিরোধী হওয়ায় অবৈধ।
তার উপর, চাইলেও জেলেনস্কির পক্ষে ইউক্রেনের ভূমি ছেড়ে দেওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়।
ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সীমান্তে যে কোনো পরিবর্তন অবশ্যই গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে।
শীর্ষস্থানীয় জনমত জরিপ সংস্থা কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির (কিআইআইএস) মে ও জুন মাসে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনীয়দের অধিকাংশই রাশিয়ার অংশ হিসেবে কোনো ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ বর্তমান ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
কিয়েভ থেকে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক আইনজীবী জেরেমি পিজি বলেন, যদি ইউক্রেনীয়রা কোনোভাবে তাদের মত পাল্টায় এবং ভূমি ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ভোট দেয়—যা কিআইআইএসের মতে সম্ভাব্য নয়—তবুও সেই চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হবে।
তিনি বলেন, 'ইউক্রেনীয় সংবিধান যাই বলুক না কেন, জেলেনস্কি বা অন্য কেউ আগ্রাসী সামরিক দখলের মাধ্যমে নেওয়া ভূখণ্ড হস্তান্তর করতে পারেন না। ভূখণ্ড দখলে সশস্ত্র শক্তি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইনে একেবারে কঠোর।'

রাশিয়াকে বিশ্বাস করার মতো কোনো যুক্তিসংগত কারণও নেই
ইউক্রেন কেন মস্কোর দাবিতে সম্মত হতে পারে না, তার পেছনে বাস্তব ও কৌশলগত উভয় কারণ রয়েছে।
বর্তমানে রুশ সেনারা লুহানস্ক প্রদেশের প্রায় পুরোটা এবং দোনেৎস্কের ৭০ শতাংশেরও বেশি এলাকা দখল করে রেখেছে। তবুও পুতিন কিয়েভের কাছে দাবি করছেন ইতোমধ্যেই যা হারিয়েছে তার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে।
দনবাস অঞ্চলের যে অংশগুলো এখনো কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেখানে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রয়েছে। স্লোভিয়ানস্ক, ক্রামাতোরস্ক এবং কস্তিয়ান্তিনিভকা শহরসহ একাধিক শিল্পনগরী প্রধান সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হয়ে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার মেরুদণ্ড তৈরি করেছে। এগুলো রাশিয়ার হাতে গেলে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অবারিত পথ খুলে যাবে।
এছাড়াও মস্কোর প্রতি আস্থা রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, বলেন আন্তর্জাতিক আইনজীবী জেরেমি পিজি।
তিনি বলেন, 'রাশিয়া গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে। এই সময়ে তারা বারবার আলোচনার ভান করেছে, সৎ উদ্দেশ্যের ভান করেছে, অথচ সহিংসতা চালিয়ে গেছে এবং একই অবৈধ, সর্বোচ্চ পর্যায়ের লক্ষ্যগুলো পেছনে রেখে দিয়েছে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে বেদনাদায়কভাবে সচেতন।'
পিজি আরও বলেন, 'রাশিয়ার প্রতি আস্থা রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, যদি না তারা নিজেদের পক্ষ থেকে সৎ উদ্দেশ্যের প্রমাণ দেয় বা আর ইউক্রেনীয়দের হত্যা না করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়।'
ইউরোপীয়দের সমর্থনে কিয়েভ ইঙ্গিত দিয়েছে যে হত্যাযজ্ঞ থামাতে তারা মাটিতে বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করতে প্রস্তুত। এর অর্থ যুদ্ধকে বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর স্থির করে দেওয়া এবং যুদ্ধবিরতির সময় হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা থেকে মূলত সরে আসা।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা সোমবার এক নোটে লিখেছেন, ইউরোপীয় নেতারা নিঃসন্দেহে ট্রাম্পকে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবেন যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।
তারা বলেন, 'যদিও কিয়েভ এবং ইউরোপীয়রা মাটিতে বর্তমান সামরিক অবস্থানকে স্বীকার করতে খোলা মন দেখাচ্ছে, কিন্তু তারা কখনও এটি স্বীকার করবে না যে রাশিয়াকে ইতোমধ্যেই দখল করা ভূখণ্ডের চেয়ে বেশি ভূমি 'দেওয়া' হোক।' তারা একটি পশ্চিমা গোয়েন্দা তথ্য উদ্ধৃত করে বলেন, বাকি দনবাস দখল করতে রাশিয়ার চার বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিয়েভ যদি স্বীকারও করে যে মাটিতে বর্তমান বাস্তবতা রাশিয়াকে কিছু ভূখণ্ডে কার্যত নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে, তবুও এটি কখনো স্থায়ী স্বীকৃতি হিসেবে গ্রহণ করবে না। কিয়েভের লক্ষ্য ভবিষ্যতে তার সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকেরাও উল্লেখ করেছেন যে ইউরোপীয় নেতাদের মনে কিছু সন্দেহ রয়েছে যে ট্রাম্প কি এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য—অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ (যুদ্ধবিরতি) এবং স্থায়ী সংযুক্তি (শান্তি চুক্তি)—বুঝতে পারছেন কিনা।
বর্তমান সহিংসতা থামানোর একমাত্র উপায় হতে পারে যুদ্ধবিরতি। তবে স্থায়ী শান্তি চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি হবে।
জেরেমি পিজি বলেন, 'আন্তর্জাতিক আইন এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে যখন ভুক্তভোগী বিজয়ী অবস্থায় নেই, তখন শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করা প্রায় রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব। আর এটাই মূল বিষয়।'