ইউক্রেনে পশ্চিমা সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান পুতিনের, লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে 'আশ্বাস প্রদানকারী' পশ্চিমা সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। একইসাথে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ইউক্রেনের মাটিতে কোনো বিদেশি সেনা মোতায়েন করা হলে, তারা রুশ সেনাবাহিনীর 'বৈধ লক্ষ্যবস্তু' হিসেবে বিবেচিত হবে।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত গ্যারান্টির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক শীর্ষ সম্মেলনের পরদিন পুতিন এই কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন।
এর আগে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানান যে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৬টি মিত্র দেশ 'স্থল, সমুদ্র বা আকাশপথে' সেনা পাঠাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মত হয়েছে। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম প্রকাশ করেননি। ম্যাক্রোঁ জোর দিয়ে বলেন, এই বাহিনীর উদ্দেশ্য রাশিয়াকে আক্রমণ করা নয়, বরং ভবিষ্যতে 'যেকোনো বড় ধরনের আগ্রাসন' প্রতিরোধ করা।
মিত্রদের এই উদ্যোগকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার লক্ষ্যে পুতিন বলেন, যদিও এখনই সেনা মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনা নেই, তবুও কোনো সেনা ইউক্রেনে প্রবেশ করলে তাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে।
আপাতত যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে। গত মাসে আলাস্কায় পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে একটি সম্ভাব্য শান্তি আলোচনার আশা জেগেছিল। তবে শুক্রবার পুতিন বলেন, তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত, কিন্তু "এর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, মূল বিষয়গুলোতে ইউক্রেনের সঙ্গে একমত হওয়া প্রায় অসম্ভব।"
পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সমাধানের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের 'গঠনমূলক ভূমিকার' প্রশংসা করলেও, 'যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে ইউরোপীয় দেশগুলোর জঘন্য প্রচেষ্টার' তীব্র সমালোচনা করেন।
আলাস্কা বৈঠকের পর থেকেই যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে 'ইচ্ছুক দেশগুলোর জোট' একটি শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে কিয়েভকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য কাজ করছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি চুক্তি তদারকির জন্য একটি 'আশ্বস্তকারী বাহিনী' মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন সমর্থন 'সম্ভবত' আকাশপথে আসতে পারে। জেলেনস্কিও জানিয়েছেন, তিনি 'ইউক্রেনের আকাশকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা' দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন।
কিয়েভের দাবি, বৃহত্তর শান্তি আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে হবে। তবে রাশিয়া এর সঙ্গে একমত নয়। রাশিয়ার দূর প্রাচ্যের ভ্লাদিভোস্তকে এক অর্থনৈতিক ফোরামে পুতিন বলেন, "যদি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির কোনো সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ইউক্রেনে বিদেশি সেনার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না।"
পুতিন মস্কোতে একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, তিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবেন। তবে জেলেনস্কি এই প্রস্তাবকে উপহাস করে বলেছেন, এটি প্রমাণ করে যে পুতিন শান্তি আলোচনায় আন্তরিক নন। এর পরিবর্তে কয়েকটি নিরপেক্ষ দেশের রাজধানীর নাম প্রস্তাব করা হলেও পুতিন সেগুলোকে 'অতিরিক্ত দাবি' বলে অভিযোগ করেছেন।
পশ্চিমা নেতারা মনে করছেন, ৪২ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে আরও ভূখণ্ড দখলের জন্য রাশিয়া মূলত সময়ক্ষেপণ করছে। বুধবার পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দাবি করেন যে তার দেশের সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের সব ফ্রন্টে এগিয়ে যাচ্ছে।
মস্কো একদিকে যেমন পশ্চিমা সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করছে, তেমনি ইউক্রেনের নিরাপত্তার 'গ্যারান্টার' বা নিশ্চয়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, যা কিয়েভ ও তার মিত্ররা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ন্যাটো প্রধান মার্ক রুট বলেছেন, "ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে রাশিয়া কী ভাবছে, তাতে আমাদের আগ্রহ কেন থাকবে? এটি একটি সার্বভৌম দেশ। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তারা কেউ নয়।"
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা মিত্রদের একটি 'অবিচ্ছেদ্য অঙ্গীকার' রয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ জানান, প্রথম অগ্রাধিকার হলো জেলেনস্কিকে নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং এরপর 'শক্তিশালী নিরাপত্তা গ্যারান্টি' প্রদান করা।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের সাড়ে তিন বছর পর পুতিন সম্প্রতি 'সুড়ঙ্গের শেষে আলো' দেখার কথা বললেও, কোনো চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নিয়ে নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এর জন্য তিনি ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত যেকোনো পরিবর্তনে গণভোট এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের শর্তকে দায়ী করেন।
ফ্রান্সের এলিসি প্রাসাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিহাসে পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তি ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির নজির রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়, যেখানে মার্কিন সেনাদের শক্তিশালী উপস্থিতির কারণে কয়েক দশক ধরে যুদ্ধবিরতি টিকে আছে। সূত্রটি জানায়, এই ধারণাটি ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
