ট্রাম্পের আশ্বাস সত্ত্বেও শান্তির পথ অনিশ্চিত, আলোচনার কেন্দ্রে এখন ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আশ্বাস পেয়ে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। তবে এই আশ্বাস বাস্তবায়নের পথ এখনও নানা প্রশ্নে জর্জরিত। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, রাশিয়া আদৌ এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে কতটা ইচ্ছুক হবে।
হোয়াইট হাউজে সোমবারের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি "একটি বড় পদক্ষেপ" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, এই সম্মেলনের ফলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পথ সুগম হবে, যা গত ৮০ বছরে ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারে।
জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মতো মিত্র দেশগুলোর নেতাদের পাশে নিয়ে এই সম্মেলনে জেলেনস্কির সাথে ট্রাম্পের উষ্ণ সম্পর্ক ছিল চোখে পড়ার মতো, যা গত ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে তাদের বিপর্যয়কর বৈঠকের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
কিন্তু উষ্ণতার বাইরে, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ এখনও গভীর অনিশ্চয়তায় ঢাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধে ১০ লাখের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে এবং এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে জেলেনস্কিকে হয়তো কিছু আপস করতে বাধ্য হতে পারে।
এদিকে, কিয়েভে সাময়িক স্বস্তির বাতাস বইলেও যুদ্ধের ময়দানে পরিস্থিতি উত্তপ্তই রয়েছে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, সম্মেলন শেষ হতেই রাশিয়া রাতভর ২৭০টি ড্রোন ও ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যা এই মাসে সবচেয়ে বড় হামলা। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে, রাশিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল মধ্য পোলতাভা অঞ্চলের জ্বালানি স্থাপনা, যেখানে ইউক্রেনের একমাত্র তেল শোধনাগার অবস্থিত। এই হামলায় সেখানে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
আশ্বাস আছে, কিন্তু নিশ্চয়তা নেই
কিয়েভ ও মস্কোতে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জন ফোরম্যান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "ভালো খবর হলো, হোয়াইট হাউজের বৈঠকে কোনো বড় ধরনের অঘটন ঘটেনি। ট্রাম্প ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণ করতে বলেননি বা সহায়তা বন্ধের হুমকিও দেননি। সার্বিক দৃশ্য ছিল ইতিবাচক এবং ট্রান্স-আটলান্টিক জোট এখনও টিকে আছে।"
"কিন্তু খারাপ দিক হলো, নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ধরণটা ঠিক কী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী ভাবছে, তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
মঙ্গলবার জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তার কর্মকর্তারা নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করছেন।
অন্যদিকে, পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে রাশিয়া কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ মঙ্গলবার বলেছেন, মস্কো শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার কোনো পথই নাকচ করছে না, তবে রাষ্ট্রনেতাদের যেকোনো বৈঠকের জন্য "সর্বোচ্চ প্রস্তুতি" থাকা আবশ্যক।
রাশিয়ার 'রেড লাইন'
প্রেসিডেন্ট পুতিন আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, রাশিয়ার মাটিতে ন্যাটোর কোনো সৈন্যকে সহ্য করা হবে না। গত শুক্রবার আলাস্কায় ট্রাম্পের সাথে বৈঠকের পরেও তিনি ভূখণ্ডগত দাবি থেকে সরে আসার কোনো ইঙ্গিত দেননি। এর মধ্যে এমন ভূখণ্ডও রয়েছে, যা এখনও রাশিয়ার সামরিক নিয়ন্ত্রণে নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও নির্দিষ্ট করে বলেননি যে, মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ঠিক কী ধরনের হবে। এমনকি শান্তি আলোচনা শুরুর আগে রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানোর দাবি থেকেও তিনি সরে এসেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার বা ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ভুলে যেতে বলেছেন।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ইউরোপ বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ম্যাথিয়াস ম্যাথিজ বলেন, "আজ এমন কোনো চুক্তি কল্পনা করা কঠিন, যা ইউক্রেন ও ইউরোপের 'রেড লাইন' এবং রাশিয়ার 'রেড লাইন'—উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে।"
মিত্রদের উদ্বেগ ও আলোচনা
ইউক্রেনের মিত্ররা মঙ্গলবার "কোয়ালিশন অফ দ্য উইলিং" ফরম্যাটে আলোচনায় বসবে, যেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।
সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, তবে দেশটির জন্য ন্যাটোর "আর্টিকেল ৫"-এর মতো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। উল্লেখ্য, ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা চুক্তির আর্টিকেল ৫-এ যৌথ প্রতিরক্ষা নীতি উল্লেখ রয়েছে, যেখানে কোনো এক সদস্যের ওপর হামলা হলে তা সকলের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়।
ইউরোইন্টেলিজেন্সের একটি নোটে বলা হয়েছে, "প্রশ্ন হলো, রাশিয়া কী মেনে নেবে? এবং পশ্চিমারা ইউক্রেনের জন্য ঠিক কতটা করতে ইচ্ছুক বা সক্ষম?"
চ্যাথাম হাউসের গবেষক ওরিসিয়া লুটসেভিচ বলেন, সোমবারের আলোচনায় "ট্রাম্প ইউক্রেনকে পুতিনের কাছে বিক্রি করে দেবেন"—এই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। তবে তিনি যোগ করেন, "পুতিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক জেলেনস্কির জন্য বিপজ্জনক। এমনকি যদি তা হয়ও, পুতিন শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার জন্য জেলেনস্কিকেই দায়ী করবেন। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো: শান্তি স্থাপনের এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত কাকে বিশ্বাস করবেন এবং দোষারোপ করবেন?"