মাত্র ১০ মিনিটের উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় যেভাবে ভেস্তে গেল ট্রাম্প-জেলেনস্কি আলোচনা

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশা করেছিলেন, শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা করেই হয়ত হোয়াইট হাউস থেকে বের হবেন। আলোচনায় একটি খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ারও কথা ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের ভবিষ্যতে বড় ধরনের অংশীদারিত্ব দেবে। খবর বিবিসির।
এই চুক্তি সরাসরি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিলেও, এটি ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবে জেলেনস্কির জন্য অপেক্ষা করছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা।
বৈঠকের একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রকাশ্যে জেলেনস্কিকে কার্যত ধমকের সুরে বললেন, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সহায়তার জন্য আরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত তার।
জেলেনস্কি অবশ্য এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, তার দেশ রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তিতে যেতে বাধ্য নয়।
ট্রাম্প ও ভ্যান্স তার এমন মনোভাবকে 'অসম্মানজনক' বলে উল্লেখ করেন।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, পূর্বনির্ধারিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আগেই হোয়াইট হাউস ছাড়তে বলা হয় জেলেনস্কিকে। এমনকি যে খনিজসম্পদ চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেটিও বাতিল করা হয়। ট্রাম্প পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, 'যখন তুমি শান্তির জন্য প্রস্তুত হবে, তখন ফিরে এসো।'
জেলেনস্কি ও ভ্যান্সের মধ্যে তর্ক
প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ও আনুষ্ঠানিকতা চললেও, বৈঠকের প্রায় আধা ঘণ্টা পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, 'শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ হতে পারে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটাই করছেন।'
এ সময় জেলেনস্কি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, 'আপনি কী ধরনের কূটনীতির কথা বলছেন, জেডি? ২০১৯ সালে ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির পরও রাশিয়া তার আগ্রাসন চালিয়ে গেছে। কেউ কি তাকে থামিয়েছে?'
জবাবে ভ্যান্স বলেন, 'আমি এমন কূটনীতির কথা বলছি, যা আপনার দেশের ধ্বংস থামাতে পারবে।'
এরপর ভ্যান্স অভিযোগ করেন, জেলেনস্কি প্রকাশ্যে মার্কিন গণমাধ্যমের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং যথেষ্ট সম্মান দেখাচ্ছেন না।
ভ্যান্সের বক্তব্য ছিল মূলত ট্রাম্পের যুদ্ধ সমাপ্তির নীতির পক্ষে, যেখানে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা ও দ্রুত যুদ্ধবিরতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আর এ নিয়েই জেলেনস্কির সঙ্গে তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়।
'আমাদের কী অনুভব করা উচিত, তা বলবেন না'
ভ্যান্স যখন ইউক্রেনের সামরিক সংকট ও সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন জেলেনস্কি বলেন, 'যুদ্ধকালীন সময়ে সবাই সমস্যার সম্মুখীন হয়, আপনাদেরও হবে। আপাতত আপনারা নিরাপদ, কারণ আপনাদের সামনে বিশাল সমুদ্র আছে। তবে ভবিষ্যতে আপনারাও এর প্রভাব টের পাবেন।'
জেলেনস্কির এই মন্তব্যে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন এবং আলোচনা, যা এতক্ষণ মূলত ভ্যান্স ও জেলেনস্কির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েন।

জেলেনস্কির বক্তব্যের মূল বার্তা ছিল যে ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে আপস করতে চাইলে সেটি আরও বড় পরিণতি ডেকে আনবে। সমালোচকদের মতে, ট্রাম্প রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন না রেখে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করে ভুল করছেন। এতে ইউক্রেন দুর্বল হয়ে পড়বে, ইউরোপে নিরাপত্তা সংকট বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত পুতিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।
ট্রাম্প বরাবরই যুদ্ধটিকে দুটি পক্ষের মধ্যে দায় ভাগ করার মতো একটি সংঘাত হিসেবে দেখেন। কিন্তু জেলেনস্কি চেয়েছিলেন তাকে বোঝাতে যে, এই যুদ্ধের আসল কারণ রাশিয়ার আগ্রাসন, এবং এটি কেবল ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
এই মন্তব্য ট্রাম্পকে চরম ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি উচ্চস্বরে বলেন, 'আমাদের কী অনুভব করা উচিত, তা বলে দেওয়ার অবস্থানে আপনি নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'আপনার হাতে এখন কার্ড নেই। আপনি লাখো মানুষের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন।'
এই বাকবিতণ্ডা জেলেনস্কির জন্য ইতিবাচক হতে পারে, বিশেষ করে যারা চান তিনি ট্রাম্পের সামনে দৃঢ় অবস্থান নিন। তবে এর পরিণতি ইউরোপের যুদ্ধ ও শান্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে।
আপনারা একা ছিলেন না': ট্রাম্পের পালটা জবাব
আলোচনার এক পর্যায়ে জেলেনস্কি বলেন, 'যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা একা ছিলাম, তবে আমরা কৃতজ্ঞ।'
এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প, যিনি বরাবরই ইউক্রেন যুদ্ধকে আমেরিকার করদাতাদের জন্য একটি বিশাল ব্যয় হিসেবে বর্ণনা করে এসেছেন।
তিনি কড়া সুরে বলেন, 'আপনারা একা ছিলেন না। আমরা আপনাদের সাহায্য করেছি—এই নির্বোধ প্রেসিডেন্টের (বাইডেন) মাধ্যমে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছি।'
এরপর ভ্যান্স জেলেনস্কির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'আপনি কি আজকের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন?' তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় জেলেনস্কি কার্যত ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে প্রচারণায় নেমেছিলেন।
ভ্যান্সের এই মন্তব্যের ইঙ্গিত ছিল জেলেনস্কির পেনসিলভানিয়ার স্ক্র্যান্টনে একটি অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনের দিকে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এটি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিজ শহর, যেখানে তিনি মার্কিন নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে সফর করেছিলেন।
রিপাবলিকানদের দাবি, জেলেনস্কির ওই সফর মূলত যুদ্ধ সংক্রান্ত নয়, বরং এটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা অভিযোগ করেন, এটি ছিল একটি প্রচারমূলক আয়োজন, যা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যে কমলা হ্যারিসের প্রচারণাকে সুবিধা দিতে পারে।
এই উত্তপ্ত মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বিভাজিত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভবিষ্যতের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
জেলেনস্কি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, 'আপনারা মনে করেন যে যুদ্ধের ব্যাপারে উচ্চস্বরে কথা বললে...'
কিন্তু ট্রাম্প সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দেন।
তিনি বিরক্ত স্বরে বলেন, 'তিনি (জেডি) উচ্চস্বরে কথা বলছেন না। আপনার দেশ বড় সংকটে আছে।'
এরপর ট্রাম্প সোজাসাপ্টা মন্তব্য করেন, 'আপনারা জিতছেন না, এটা সত্য। তবে আমাদের কারণে আপনাদের টিকে থাকার ভালো সম্ভাবনা আছে।'
কী মূল্য দিতে হবে তাহলে?
ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এই পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন হবে। চুক্তি করতে হলে মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট উভয়েই জেলেনস্কির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন, বিশেষ করে তার কথাবার্তায় যে 'আগ্রাসী মনোভাব' ফুটে উঠেছে, সেটি তাদের বেশি ক্ষুব্ধ করে।
একপর্যায়ে ভ্যান্স সরাসরি বলেন, 'শুধু ধন্যবাদ জানান। '

কিন্তু জেলেনস্কি নতিস্বীকার করেননি। বরং যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দুই ক্ষমতাধর নেতার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চান।
তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, কারণ এটি তার দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। তিন বছর ধরে তিনি শুধু সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলা করছেন না, বরং দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন, যা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুর্বল করতে চান।
তবে কক্ষের অন্য প্রান্তে, ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে, আরেকটি দৃশ্য ছিল।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওক্সানা মারকারোভাকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়, যখন বাকবিতণ্ডা তুঙ্গে ওঠে।
এই দৃশ্য যেন প্রতিফলিত করে ইউক্রেনের কূটনৈতিক বাস্তবতা—এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরতার টানাপোড়েন।
ট্রাম্পের সামনে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় জেলেনস্কির কূটনৈতিক সাহস প্রশংসনীয় হতে পারে। তবে এর চূড়ান্ত পরিণতি যদি হয় পুতিনের কাছে দুর্বল হয়ে পড়া, তাহলে এই অবস্থানের মূল্য কতটা হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।