জাপানের সঙ্গে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তির’ ঘোষণা ট্রাম্পের, শুল্ক কমে ১৫%
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করেছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি গাড়ি আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। এর বদলে জাপান যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণ দেবে।
এটি এপ্রিলে ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর তার করা সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তিগুলোর একটি। এই চুক্তির ফলে জাপানকে নতুন কোনো কড়া শুল্কের মুখে পড়তে হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া জাপানের মোট পণ্যের মধ্যে অটোমোবাইল খাতের অংশ এক চতুর্থাংশেরও বেশি। এই খাতে বিদ্যমান শুল্ক শতকরা ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। একইসঙ্গে, ১ আগস্ট থেকে জাপানের যেসব পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক বসানোর কথা ছিল, সেগুলোর হারও একইভাবে কমিয়ে আনা হবে।
এই ঘোষণার পর টোকিওর শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান ঘটে। জাপানের প্রধান নিক্কেই সূচক এক বছরে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়—বৃদ্ধি হয় শতকরা ৩ শতাংশেরও বেশি। বিশেষ করে টয়োটা ও হোন্ডার শেয়ারের দাম অনেক বেড়ে যায়। টয়োটার শেয়ার বাড়ে ১৪ শতাংশের বেশি এবং হোন্ডার শেয়ার বাড়ে প্রায় ১২ শতাংশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশাল'-এ দেওয়া এক বার্তায় লিখেছেন, 'আমি জাপানের সঙ্গে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তিতে সই করেছি। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সময়। বিশেষ করে, আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপানের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে—এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
এদিকে স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, রোববারের নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয়ের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগগিরই পদত্যাগ করতে পারেন। তিনি এই চুক্তিকে বর্ণনা করেছেন 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে—এমন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম হারে শুল্ক' হিসেবে।
চুক্তির আওতায় জাপানকে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্যাকেজে রাখা হয়েছে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও গ্যারান্টি। জাপানের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এই অর্থ প্রদান করা হবে, যাতে দেশটি ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে টেকসই সরবরাহ চেইন গড়ে তুলতে পারে—এমনটাই জানিয়েছেন ইশিবা।
চুক্তির অংশ হিসেবে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে চালের আমদানি বাড়াবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা। ইশিবা জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে চালের আমদানির পরিমাণ বিদ্যমান কাঠামোর আওতায় বাড়তে পারে, তবে এ চুক্তি জাপানের কৃষি খাতকে কোনোভাবেই ক্ষতির মুখে ফেলবে না।
এই বাণিজ্য চুক্তির প্রভাব দক্ষিণ কোরিয়ার শেয়ারবাজারেও পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানের পরে দক্ষিণ কোরিয়াও এমন চুক্তি করতে পারে—এই আশায় সেখানে গাড়ি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। ডলারের তুলনায় ইয়েনের মান কিছুটা বাড়ে, আর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেও ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট। তারা বলছে, জাপান থেকে আসা গাড়ির ওপর শুল্ক কমানো হলেও, কানাডা ও মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব গাড়ি আসে, সেগুলোর ওপর এখনো শতকরা ২৫ শতাংশ শুল্ক আছে। অথচ ওই গাড়িগুলোর অনেক উপাদানই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি।
এ বিষয়ে আমেরিকান অটোমোটিভ পলিসি কাউন্সিলের প্রধান ম্যাট ব্লান্ট বলেন, 'যেসব গাড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই নেই, সেগুলোর ওপর কম শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে, অথচ যেসব গাড়ি অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি উপাদানে গঠিত, তাদের ওপর রাখা হচ্ছে বেশি শুল্ক। এটা আমাদের শিল্প ও শ্রমিকদের জন্য একেবারেই প্রতিকূল।'
'মিশন কমপ্লিট'
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে গাড়ি বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরেই একমুখী। প্রায় সব গাড়ি ও যন্ত্রাংশই জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যায়—এ নিয়ে বরাবরই অসন্তুষ্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জাপান থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি গাড়ি ও অটোমোটিভ যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপানে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের সামান্য কিছু গাড়িপণ্য।
২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে জাপানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম বৃহত্তম পণ্য বাণিজ্য অংশীদার।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে জাপানের প্রধান শুল্ক আলোচক রিওসেই আকাজাওয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর চুক্তির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। পরে এক্স-এ আকাজাওয়া লেখেন, '#মিশন কমপ্লিট'। তবে তিনি জানান, এ চুক্তিতে জাপানের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি অন্তর্ভুক্ত নয়—যেগুলোর ওপর এখনও শতকরা ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক রয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়েও কোনো সমঝোতা হয়নি।
অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ক্লিফটন বলেন, 'ট্রাম্পের আগের একতরফা শুল্ক হুমকি মাথায় রাখলে, এই চুক্তি জাপানের জন্য একটি ভালো ফলাফল হয়েছে।'
মেইজি ইয়াসুদা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ কাজুতাকা মায়েদা বলেন, '১৫ শতাংশ শুল্কের হার থাকায়, আমি আশা করি জাপানের অর্থনীতি মন্দা থেকে বাঁচবে।'
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ জাপান। দেশটির সরকারি পেনশন তহবিল জিপিআইএফ ও বিভিন্ন বীমা কোম্পানির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্যাংক অব জাপানের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্রে জাপানের সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ওই বছর উত্তর আমেরিকায় মোট সরাসরি বিনিয়োগ ছিল ১৩৭ বিলিয়ন ডলার।
হোয়াইট হাউসে এক বক্তব্যে ট্রাম্প আরও জানান, আলাস্কায় প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে রাজি হয়েছে জাপান। এ নিয়ে তার প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে আগ্রহ দেখিয়ে আসছিল। ট্রাম্প বলেন, 'আমরা একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছি ... আর এখন আরেকটি চুক্তি করব কারণ তারা আলাস্কায় আমাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গঠন করছে, যেমনটা আপনি জানেন, এলএনজি জন্য। তারা এখন সেই চুক্তি করতে প্রস্তুত।'
আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন করে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের সময়সীমা এগিয়ে আসায় ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত একের পর এক বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে। বাজারের চাপ ও বিভিন্ন খাতের তীব্র লবির মুখে তিনি একাধিকবার সময়সীমা পেছালেও এবার তা কার্যকর করার প্রস্তুতি চলছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চুক্তির খসড়া হয়েছে এবং চীনের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে এসব চুক্তির বিস্তারিত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্ক আলোচকরা আগামীকাল (বুধবার) ওয়াশিংটনে আসছেন।