নির্বাচনে বড় পরাজয়ের পরও পদত্যাগ না করার ঘোষণা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর

জাপানের ক্ষমতাসীন জোট দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা জানিয়েছেন, পদত্যাগ করার কোনো পরিকল্পনা তার নেই।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও মার্কিন শুল্ক হুমকির কারণে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও তার ছোট শরিক কোমেইতোর জোটের প্রতি সৃষ্ট অসন্তোষের মধ্যেই ভোটাররা রোববারের এই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভোট দেন।
রোববার ভোটগ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই 'কঠোর ফলাফল' তিনি 'বিনীতভাবে' মেনে নিচ্ছেন, তবে তার মূল মনোযোগ এখন বাণিজ্য আলোচনার দিকে।
গত বছর জাপানের অধিকতর শক্তিশালী নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর এখন এই পরাজয় জোটের প্রভাবকে আরও দুর্বল করবে।
সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে, ২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ক্ষমতাসীন জোটের ৫০টি আসনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একটি আসনের ফলাফল ঘোষণা বাকি থাকতেই জোটটি ৪৭টি আসন পেয়েছে।
রোববারের নির্বাচনে উচ্চকক্ষের অর্ধেক আসনে ভোটগ্রহণ হয়। এতে সদস্যরা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
কান্দা ইউনিভার্সিটি অভ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জাপানিজ স্টাডিজের প্রভাষক জেফরি হল বিবিসি নিউজকে বলেন, আরও ডানপন্থি দলগুলো এলডিপির রক্ষণশীল ভোটব্যাংকে ভাগ বসিয়েছে।
তিনি বলেন, 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী [শিনজো] আবের অনেক সমর্থক প্রধানমন্ত্রী ইশিবাকে যথেষ্ট রক্ষণশীল মনে করেন না। তারা মনে করেন, ইতিহাস নিয়ে তার সেই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেই, কিংবা আবের মতো চীনের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানও নেই।'
শিনজো আবে আগে এলডিপির নেতা ছিলেন। জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০০৭ ও ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
হল বলেন, এলডিপির কিছু সমর্থন সানসেইতো পার্টির দিকে চলে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, এই দলটি 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বিদেশি-বিরোধী বক্তব্য ও ইতিহাস সম্পর্কে অত্যন্ত কট্টর সংশোধনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির' দিকে ঝুঁকেছে এবং তাদের সদস্যরা এমন সব কথা বলবেন যা 'এর আগে উচ্চকক্ষের সদস্যরা প্রকাশ্যে বলেননি'।
ইশিবার মধ্য-ডানপন্থি দলটি ১৯৫৫ সাল থেকে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে জাপান শাসন করে আসছে, যদিও ঘন ঘন নেতা বদলেছে।
এই ফলাফল ইশিবার প্রতি ভোটারদের হতাশারই প্রতিফলন। জাপানের অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা, জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে চালের দাম এবং গত কয়েক বছরে এলডিপিকে জর্জরিত করা একাধিক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি নিয়েও অনেকে ক্ষুব্ধ।
এর আগে এলডিপির যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই দুই মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এ নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয়ের ফলে একই পরিণতি হতে পারে।
এমনটা হলে এলডিপির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সদস্যদের জন্য নেতৃত্বের দৌড়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে। এদের মধ্যে রয়েছেন গত বছরের নেতৃত্বের নির্বাচনে ইশিবার কাছে দ্বিতীয় হওয়া সানে তাকাইচি, সাবেক অর্থনৈতিক নিরাপত্তামন্ত্রী তাকাইউকি কোবায়াশি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমির ছেলে শিনজিরো কোইজুমি।
যা-ই হোক না কেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন এলে তা নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক নাটকীয়তার জন্ম দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বাণিজ্য আলোচনার এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জাপান সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
সোমবার সরকারি ছুটির কারণে টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ ছিল, কিন্তু বিশ্ববাজারে অন্যান্য প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ইয়েনের দর বেড়েছে। কারণ এই ফলাফল বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
ছোট, ডানপন্থি দল সানসেইতোর প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন জোটের প্রতি সমর্থন কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দলটি 'জাপানিজ ফার্স্ট' ও অভিবাসন-বিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে রক্ষণশীল ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে।
করোনা মহামারির সময় সানসেইতো প্রথম ইউটিউবে পরিচিতি লাভ করে। সে সময় তারা টিকা ও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অভিজাতদের একটি গোপন চক্র সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছিল।
রোববারের ভোটের আগে দলটির এই জাতীয়তাবাদী বক্তব্য তাদের আবেদন আরও বাড়িয়ে তোলে। কারণ বিদেশি বাসিন্দা ও অভিবাসন-সংক্রান্ত নীতিগুলো অনেক দলের প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
বিচ্ছিন্নতাবাদী সংস্কৃতি ও কঠোর অভিবাসন নীতির জন্য পরিচিত এই দ্বীপরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটক ও বিদেশি বাসিন্দা উভয়ই রেকর্ড সংখ্যায় বেড়েছে।
এই জনস্রোত জাপানিদের জন্য জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে কারও কারও মধ্যে এই ধারণার জন্ম দিয়েছে যে বিদেশিরা দেশটির সুযোগ নিচ্ছে—যা অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই একই প্রেক্ষাপটে ইশিবা গত সপ্তাহে 'কিছু বিদেশি নাগরিকের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বা উপদ্রবমূলক আচরণ'—যার মধ্যে অভিবাসন, জমি অধিগ্রহণ ও সামাজিক বিমা পরিশোধ না করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে—মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি টাস্ক ফোর্স চালু করেছেন।