লাল গালিচা অভ্যর্থনা, বিরল খনিজ চুক্তি ও নোবেল মনোনয়ন নিয়ে জাপান সফর শেষ করলেন ট্রাম্প
প্রশংসা, নোবেল মনোনয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি—সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একেবারে লাল গালিচা মেলে স্বাগত জানিয়েছেন জাপানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। খবর বিবিসির।
বিনিময়ে ট্রাম্প তাকাইচির প্রশংসা করে বলেন, 'জাপানের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, যে কোনো সহায়তা—সবকিছুতেই যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে।'
এই সাক্ষাতে দুই নেতা বিরল খনিজ নিয়ে একটি চুক্তি এবং আরও একটি নথিতে স্বাক্ষর করেন, যা যুক্তরাষ্ট্র–জাপান সম্পর্কের "সোনালি যুগ" সূচনার ঘোষণা দেয়। এতে তারা আগের চুক্তিগুলো, বিশেষ করে চলতি বছরের শুরুর দিকে হওয়া ১৫ শতাংশ শুল্কসংক্রান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিবেশটিও ছিল বেশ আড়ম্বরপূর্ণ, যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে কেন্দ্র করেই সব সাজানো হয়েছে।
জাঁকজমকপূর্ণ আকাসাকা প্রাসাদে পৌঁছালে পূর্ণ সামরিক গার্ড অব অনার এবং ব্যান্ড বাজিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো হয়। সোনালি অলঙ্করণে সজ্জিত সেই প্রাসাদের উঁচু ছাদ ও দৃষ্টিনন্দন দেয়ালগুলো অনেকটা সেই ধাঁচের, যেমনটি ট্রাম্প তার পরিকল্পিত হোয়াইট হাউসের বলরুমে চান।
দুপুরের খাবারের সময় ট্রাম্প জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাকাইচিকে অভিনন্দন জানান।
উল্লেখযোগ্যভাবে, হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সেই দুপুরের খাবারে ছিল 'আমেরিকান চাল ও আমেরিকান গরুর মাংস, যা জাপানি উপকরণে সুস্বাদু করে রান্না করা হয়েছিল।' এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ট্রাম্পকে আনন্দিত করেছে, কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাপানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাল কেনার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
সানায়ে তাকাইচি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জর্জ ওয়াশিংটনে যান, যেখানে হাজারো মার্কিন সেনা উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে তাদের স্বাগত জানায়।
মঞ্চে উঠে তাকাইচি যুক্তরাষ্ট্র–জাপান সম্পর্ককে 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জোট' বলে অভিহিত করেন এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
এই ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর আগে ট্রাম্প বারবার জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যয়ে অনীহা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্র–জাপান নিরাপত্তা চুক্তিকে 'একপাক্ষিক' বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, 'আমরা তাদের রক্ষা করতে বিলিয়ন ডলার খরচ করি, কিন্তু তারা কিছুই দেয় না।'
বুধবারের বৈঠকের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি নিশ্চিত যে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে তার একটি 'অসাধারণ সম্পর্ক' গড়ে উঠবে। তিনি উল্লেখ করেন, তাকাইচির সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিনজো আবের দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। আবেকে ২০২২ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মালয়েশিয়া থেকে জাপানে যাওয়ার পথে বিমানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, 'তিনি (তাকাইচি) ছিলেন আবের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বন্ধু, আর আবে ছিলেন আমারও বন্ধু… তিনি ছিলেন সেরাদের একজন… আমি জানি তারা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আর আমার মনে হয় তাদের চিন্তাধারাও অনেকটা মিল ছিল, যা খুবই ভালো বিষয়।'
ট্রাম্প বর্তমানে এক সপ্তাহের এশিয়া সফরে রয়েছেন। বুধবার তিনি জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাবেন এবং বৃহস্পতিবার সেখানেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে জাপানের সংসদ সদস্যদের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ঘনিষ্ঠ মিত্র, তবে ট্রাম্পের অস্থির ও অনিশ্চিত মনোভাব এবং অতীতে জাপানের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিতে দ্বিধা দেখা দেওয়ায় এই সম্পর্ক বজায় রাখা এখন জাপানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বুধবারের বৈঠকে তাকাইচি ট্রাম্পকে 'নতুন সোনালি যুগের অংশীদার' হিসেবে অভিহিত করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি আরও ঘোষণা দেন যে, জাপান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেবে।
ট্রাম্পের সহকারী মারগো মার্টিনের তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি ট্রাম্পকে বেশ কয়েকটি গলফ-সম্পর্কিত উপহার দেন। এর মধ্যে ছিল হিদেকি মাতসুয়ামার স্বাক্ষর করা একটি গলফ ব্যাগ, যিনি প্রথম জাপানি পুরুষ গলফার হিসেবে কোনো বড় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন, এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ব্যবহৃত একটি পাটার (গলফ ক্লাব)। এছাড়া, তারা দুজন 'জাপান ইজ ব্যাক' লেখা দুটি ক্যাপে স্বাক্ষরও করেন।
বিনিময়ে ট্রাম্প তাকাইচিকে 'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' বলে উল্লেখ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র–জাপান জোটকে 'একটি সুন্দর বন্ধুত্ব' বলে আখ্যা দেন, যা 'এক ভয়াবহ যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নিয়েছে।'
তিনি আরও ঘোষণা দেন যে, জাপানের এফ–৩৫ যুদ্ধবিমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম চালান তিনি অনুমোদন করেছেন, যা এই সপ্তাহেই সরবরাহ করা হবে।
এখন পর্যন্ত বৈঠকগুলো সৌজন্য ও আনুষ্ঠানিকতার আবহে ইতিবাচকভাবে এগোলেও হাসি ও আড়ম্বরের আড়ালে জাপানের ওপর রয়েছে চাপ।
দুপুরের কর্ম সভায় তাকাইচি ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের মানচিত্র উপহার দেন, যাতে দেখানো হয় জাপানের অর্থনৈতিক অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরে বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জর্জ ওয়াশিংটনে দেওয়া বক্তৃতায় ট্রাম্প জানান, তাকাইচি তাকে জানিয়েছেন যে টয়োটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নতুন কারখানা নির্মাণে ১০ বিলিয়ন ডলার (৭.৫ বিলিয়ন পাউন্ড) বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
তবে এসব ইতিবাচক ঘোষণার মধ্যেও ট্রাম্প জাপানের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার আরও বাড়াতে চান। তিনি চান, জাপান শুধু আরও বেশি চাল নয়, সয়াবিনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করুক, পাশাপাশি জাপানের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি গাড়ির জন্যও উন্মুক্ত হোক।
তবে তাকাইচিকেও দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পখাত রক্ষা করতে হবে, এবং ঘরোয়া প্রভাবশালী গোষ্ঠী—বিশেষ করে শক্তিশালী কৃষক শ্রেণিকে বিরক্ত করতে তিনি চান না।
রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি হওয়ায় জাপান কোনোভাবেই শুল্ক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পারে না, বিশেষত গাড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকারক হিসেবে দেশের সবচেয়ে বড় খাত এই অটোমোবাইল শিল্প অতীতে ২৪ শতাংশ শুল্কের বোঝা ও দশকের পর দশক ডলারে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
বর্তমানে শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হয়েছে, যা এখন দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বিশেষ উপদেষ্টা তোমোহিকো তানিগুচি বলেছেন, তাকাইচি তার প্রয়াত পরামর্শদাতার মতোই ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে কিছু দিক থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। তার মতে, তাকাইচির উচিত হবে খোলামেলা ও স্পষ্টভাবে জাপানের জাতীয় স্বার্থ তুলে ধরা, পাশাপাশি দুই দেশের স্বার্থ কোথায় মিলছে তা চিহ্নিত করা, এবং সর্বদা মনে রাখা যে জাপানের নিরাপত্তা জাপানিদের হাতেই থাকা উচিত।
তবে তাকাইচির জন্য চ্যালেঞ্জ কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা নয়—তাকে একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্কও বজায় রাখতে হবে।
এশিয়া গ্রুপের সিনিয়র সহযোগী রিনতারো নিশিমুরা বলেছেন, তাকাইচিকে এখন 'খুব সূক্ষ্ম ভারসাম্য রেখে হাঁটতে হবে'—সম্ভবত তাকে চীনের বিষয়ে তার কঠোর অবস্থান কিছুটা নরম করতে হবে, তবে একই সঙ্গে ট্রাম্পকে এটিও নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র–জাপান সম্পর্কই জাপানের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
