বিস্ময়কর দুর্বল ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ, সামনে এগোচ্ছে রুশ সেনারা

ইউক্রেনের আভদিভকা শহর এখন রুশ বাহিনীর দখলে। পূর্বাঞ্চলের এই শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটু একটু করে আরো সামনে এগোচ্ছে রুশ সেনারা। ফুরিয়ে আসা গোলাবারুদ এবং পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তা কমতে থাকায়– ইউক্রেনীয়রা নিরুপায় হয়ে দেখছে।
গোলাবারুদ বা অস্ত্রের সংকটই শুধু নয়; ওই এলাকায় রুশ সেনারা অগ্রসর হতে পারছে মূলত দুর্বল ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ কাঠামোর কারণে।
আদদিভকার পশ্চিমের এই এলাকাটি ইউক্রেন রক্ষা করতে চায়, কিন্তু প্রতিরোধ কাঠামো বলতে সেখানে রয়েছে যেনতেন ভাবে নির্মিত অল্পসংখ্যক পরিখা। বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবস এর কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা চিত্র বিশ্লেষণ করে এমনটাই জানিয়েছে মার্কিন দৈনিক– দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণে দেখা গেছে– পরিখাগুলোর নেই রাশিয়ান ট্যাংক বা সাঁজোয়া যান ঠেকানোর মতো অতিরিক্ত মজবুত কাঠামো বা দুর্গপ্রাকার। ফলে এ অঞ্চলের প্রধান প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমি অরক্ষিত রয়েছে।
গত নয় মাসের মধ্যে আভদিভকার লড়াই ছিল সবচেয়ে তীব্র। ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী ছিল এই লড়াই। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আভদিভকার দখল নেয় রুশ সেনারা, গত বছরের মে মাসের পর যা ইউক্রেনে মস্কোর সবচেয়ে বড় জয়।
আভদিভকা থেকে পিছু হটার পরে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা শহরের বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত এক সপ্তাহের মধ্যে রুশ সেনারা আভদিভকার পশ্চিমের তিনটি গ্রাম দখল করেছে, এবং আরেকটি গ্রামের দখল নিতে লড়াই করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন কর্মকর্তারা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, আভদিভকার বাইরের প্রতিরোধ সারি আগে থেকে দৃঢ় করার দিকে মনোযোগ দেয়নি ইউক্রেন। ফলে রুশ সেনা ইউনিটগুলো ধীরে ধীরে আরো সামনে অগ্রসর হতে পারবে।
ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বৃহস্পতিবার জানায়, গত দুই সপ্তাহে রুশ সেনারা আভদিভকার কেন্দ্র থেকে চার মাইল অগ্রসর হয়েছে। এটি তাঁদের আগের আক্রমণ অভিযানগুলোর তুলনায় বেশ দ্রুতগতিতে এগোনোর ঘটনা।
আভদিভকার বাইরে প্রতিরোধ দৃঢ় করার যথেষ্ট সময় ছিল ইউক্রেনের সেনানায়কদের হাতে। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ২০১৪ সালের পর থেকেই ডনবাসে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহ শুরু হলে- আভদিভকা বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। দুই বছর আগে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পরেও– দীর্ঘসময় এই শহর শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করেছে ইউক্রেনীয়রা।
কিন্তু, দেখা যাচ্ছে শহরের বাইরের অংশে প্রতিরোধ কাঠামো গড়ে তোলা নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেননি। এখানকার পরিখাগুলোয় মাটি দিয়ে কিছু অংশ দৃঢ় করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের। মাটির তৈরি কাঠামো থেকে বেরিয়ে সেনাদের পরিখায় প্রবেশ করে অবস্থান নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও– এর বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
রাশিয়ার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামো
রাশিয়ার ব্যাপক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামো– পরিখা, বাঙ্কার, পিলবক্স ইত্যাদির সাথে তুলনা করলে ইউক্রেনীয় পরিখাগুলোর নাজুক অবস্থা সহজেই অনুধাবন করা যায়। রাশিয়ার দৃঢ় প্রতিরোধ কাঠামোর কারণেই গত গ্রীষ্মে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা-আক্রমণ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়ে, এবং শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
যেমন ভারবোভ গ্রামের বাইরে রাশিয়া যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছে– তার ফলে গ্রামটি দখল করার চেষ্টা ব্যর্থ হয় ইউক্রেনের। আভদিভকার বাইরের যে গ্রামগুলো এখন রুশ সেনারা দখলের চেষ্টা করছে, সেখানে ইউক্রেনের প্রতিরোধ কাঠামো যতোটা দুর্বল– তারই বিপরীত যেন ভারবোভ। এখানে রুশ বাহিনী কয়েক স্তরের মজবুত কাঠামো নির্মাণ করেছে।
যার শুরুতেই রয়েছে ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যানের গতিরুদ্ধ করার উপযোগী প্রশস্ত পরিখা, ট্যাংককে বাধা দিতে তারপরে আরো রয়েছে 'ড্রাগনস টিথ' নামক কংক্রিট দিয়ে তৈরি প্রতিবন্ধকতার সারি। আরো পেছনে নির্মাণ করা হয়েছে পদাতিক সেনাদের জন্য কয়েক সারি পরিখা।

স্যাটেলাইট থেকে তোলা চিত্র ফেব্রুয়ারি মাসে ভারবোভের বাইরে রাশিয়ার এসব প্রতিরক্ষা কাঠামো স্পষ্টই দেখা গেছে। এখানে প্রচণ্ড লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে রয়েছে আশেপাশের খোলামাঠে কামানের গোলার বিস্ফোরণে তৈরি হওয়া হাজার হাজার গর্ত।
ইউক্রেনের দুর্বল প্রতিক্ষার কারণ কী?
ইউক্রেনের যথাযথ প্রতিরক্ষা না থাকার পেছনে সম্ভাব্য বেশকিছু কারণ থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরে ইউক্রেনের সেনা কর্মকর্তারা আক্রমণ অভিযানেই বেশি মনোযোগ দেন, এবং রাশিয়ার কমব্যাট ইঞ্জিনিয়াররা ২০২২ সাল থেকে যেসব পরিখা ও ট্যাংকের ফাঁদ তৈরি করেছেন– সেগুলো ধ্বংসের জন্য তাঁদের হাতে থাকা সরঞ্জামের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। অভিযানের সময় এ ধরনের অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি ধবংস হয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল সেরহি হারবস্কি বলেন, 'এসময় প্রতিরোধ সারি নির্মাণের কথা তাঁরা ভাবেননি বা এটিকে একটি উপায় হিসেবেও আমলে নেননি। কারণ এটি খুবই ব্যয়বহুল একটি কাজ।"
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে মনস্তাত্ত্বিক একটি দিকও কাজ করেছে। ইউক্রেনীয় সেনারা যদি ওই এলাকায় প্রচুর মাইন বা বিস্ফোরক পেতে রাখতো, তাহলে তাঁরা পরোক্ষভাবে এটাই স্বীকার করে নিতে যে– ভবিষ্যতে তাঁরা এখানে আক্রমণ অভিযানে আর নামবে না। এক কথায়, বিষয়টি হতো রাশিয়াকে পুরোপুরি ওই এলাকার অধিকার ছেড়ে দেওয়ার শামিল।
তাছাড়া, কিয়েভের কাউন্টার-অফেন্সিভ শুরুর মাস ছয়েক আগে রাশিয়া দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিরক্ষা সারিগুলো নির্মাণ করে। যেখানে ইউক্রেন মাত্র তিন মাস আগে আভদিভকায় এ ধরনের কাঠামো নির্মাণে হাত দেয়। এই কাজে ইউক্রেনের সেনাদের সাথে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় সরকারও অংশ নেয়।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, সম্মুখভাগের প্রতিরক্ষা সারি নির্মাণের কাজ সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোতায়েন ইউক্রেনের সামরিক ইউনিটগুলো নেয়। তবে বেসরকারি ঠিকাদারদের সাহায্য নিয়ে পেছনের প্রতিরক্ষা সারিগুলো নির্মাণ করছে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ। এজন্য চলতি বছরে ৩০ বিলিয়ন রিভনিয়া (ইউক্রেনীয় মুদ্রা) বা ৮০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানান ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শিমহাল।
গত নভেম্বরে আভদিভকা সফরে এসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেন, পূর্বের ডনবাস অঞ্চলে (যেখানে আভদিভকা অবস্থিত) প্রতিরোধ কাঠামো নির্মাণে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এসময় তিনি দ্রুত এসব কাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন।
তবে স্যাটেলাইট চিত্র ও যুদ্ধক্ষেত্রের মিডিয়া কনটেন্ট বিশ্লেষক সংস্থা– ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপের বিশেষজ্ঞ পাসি পারোইনেন বলেন, জেলেন্সকির সফরের পর থেকে এখানে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই হয়নি। "আভদিভকার বাইরে কিছু নতুন সেনা অবস্থান প্রস্তুত করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো দুর্জেয় প্রতিরোধ সারি হিসেবে নির্মিত হয়নি। দক্ষিণ দিকে রাশিয়ার নির্মিত প্রতিরক্ষার সাথেও তুলনা করবার মত নয়।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ