বর্তমান সীমান্ত রেখাতেই ইউক্রেনে বিশেষ অভিযান থামাতে চান পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে প্রস্তুত, তবে শর্ত হলো—বর্তমান যুদ্ধরেখায় যুদ্ধ থামবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টায় এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে ফিন্যানশিয়াল টাইমস জানিয়েছে।
জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন বলেন, ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল মস্কো আংশিক দখলে রেখেছে, সেখানকার কিয়েভের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশগুলো ছেড়ে দিতে রাজি তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও একটি সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে ভাবছে, যেখানে কিয়েভের ওপর চাপ দিয়ে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রাশিয়ার দখল স্বীকার করা এবং ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলের রাশিয়ার বর্তমান নিয়ন্ত্রণকেও মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে—বলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এই প্রস্তাবই যুদ্ধ শুরুর তিন বছর পর প্রথমবারের মতো পুতিনের পক্ষ থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত, যেখানে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া তার আগের কড়া শর্ত থেকে কিছুটা পিছু হটতে পারে।
তবে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা এই মার্কিন প্রচেষ্টা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তাদের মতে, পুতিন এমন প্রস্তাব দিয়ে আসলে ট্রাম্পকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছেন, যাতে ট্রাম্প রাশিয়ার আরও কিছু দাবিও ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন।
একজন ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেন, 'এই মুহূর্তে কিয়েভের ওপর অনেক চাপ আছে। যেন ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।'
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বুধবার লন্ডনে ইউরোপীয় ও মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন, সাম্প্রতিক শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে।
তবে মার্কিন সূত্র ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ওই বৈঠক থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে ট্রাম্পের ইউক্রেন বিষয়ক আরেক প্রতিনিধি কিথ কেলোগ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
রুশ বার্তাসংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, পুতিনের পররাষ্ট্র নীতির উপদেষ্টা জানিয়েছেন—উইটকফ এই সপ্তাহেই মস্কো সফর করবেন।
রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ফিন্যানশিয়াল টাইমসকে বলেন, 'আমরা আমেরিকানদের সঙ্গে আলোচনা করছি। বিষয়টি কঠিন, সময়সাপেক্ষ, এবং প্রকাশ্যে এগুলো সম্ভব নয়। কাজ চলছে, তবে দ্রুত ফলাফল আশা করা যাচ্ছে না।'
রোববার সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, তিনি আশা করছেন এই সপ্তাহেই ইউক্রেন ও রাশিয়া একটি চুক্তিতে পৌঁছাবে এবং তারপর 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারবে'।
গত সপ্তাহে প্যারিসে ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে হোয়াইট হাউস থেকে একটি সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির কাঠামো নিয়ে কিছু ধারণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, ট্রাম্পের কাছ থেকে যুদ্ধ শেষ করতে স্পষ্ট কোনো প্রস্তাব এখনো তিনি পাননি। তবে যুদ্ধবিরতির পরিস্থিতি তৈরি হলে তিনি সরাসরি পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।
জেলেনস্কি বলেন, 'ইঙ্গিত আছে, আলোচনা আছে, ধারণাও আছে—কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নয়।' তিনি আরও বলেন, 'যদি কখনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসে, আমরা অবশ্যই জবাব দেব।'
যদিও ২০২০ সালে পুতিন সংবিধানে এমন সংশোধনী আনেন যা রাশিয়ার দখলকৃত কোনো অঞ্চল ত্যাগ করার পথ বন্ধ করে দেয়, তবুও ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ পত্রিকা সম্পাদক কনস্টান্টিন রেমচুকভ রবিবার এক কলামে দাবি করেছেন—যদি রাশিয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীকে কুরস্ক অঞ্চল থেকে পুরোপুরি হটিয়ে দিতে পারে, তবে যুদ্ধ থামানোর পথ তৈরি হতে পারে।
গত বছর কিয়েভ কুরস্ক অঞ্চলে ঢুকে পড়ে, কিন্তু শনিবার ক্রেমলিন দাবি করে, অঞ্চলটির ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ এখন আবার রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
রেমচুকভ নিজাভিসিমায়া গেজেতা-তে লেখেন, 'যখন তারা শেষ অর্ধ শতাংশ এলাকাও পুনর্দখল করে নেবে, তখন যেই মুহূর্তে সেই খবর সেনাদের কাছে পৌঁছাবে, সেদিনই তারা যেখানে থাকবে সেখানেই থেমে যেতে পারবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প বিষয়টি বুঝে গেছেন উইটকফের মাধ্যমে। আর আশা করা হচ্ছে, এই পুরো ব্যাপারটা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন হবে, যাতে ট্রাম্প গর্ব করে বলতে পারেন—প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশন শেষ করেছেন।'
পুতিন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্রেমলিনে আয়োজিত একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চারটি প্রদেশকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন—যদিও সে সময় কোনো প্রদেশই রাশিয়ার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
বর্তমানেও রাশিয়া ওই চারটি অঞ্চল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। তবে ২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনে স্থানীয় অনুগত বাহিনীর মাধ্যমে গোপন আগ্রাসন চালানোর পর থেকে ডনেতস্ক ও লুহানস্কের আঞ্চলিক রাজধানীগুলো তাদের দখলে রয়েছে।
২০২২ সালের শরতে রাশিয়া কিছু এলাকা থেকে পিছু হটলেও পুতিন গত বছর স্পষ্ট করে দেন—ইউক্রেন যদি শান্তিচুক্তি চায়, তবে তাদের ফ্রন্টলাইন থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং ওই চারটি প্রদেশ—যার মধ্যে জাপোরিঝিয়া শহরও রয়েছে—সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে দিতে হবে। উল্লেখ্য, জাপোরিঝিয়া শহরটি রাশিয়া কখনোই দখল করতে পারেনি, তবে নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে মস্কোর পক্ষ থেকে শান্তিচুক্তির জন্য যেসব শর্ত তোলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করা, দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর রাশিয়ার দাবি স্বীকৃতি দেওয়া, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলোতে বাহিনী হ্রাস করা।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, 'আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না।'