তিন বছর যুদ্ধের পর ইউক্রেনকে সরাসরি শান্তি আলোচনার প্রস্তাব পুতিনের

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি শান্তি আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন। রোববার (১১ মে) ভোররাতে ক্রেমলিন থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি জানান, আগামী ১৫ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। পুতিন বলেন, এই আলোচনা 'যুদ্ধের মূল কারণ দূর করা' এবং 'দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করাই' রাশিয়ার লক্ষ্য।
তিনি বলেন, 'আমরা কিয়েভকে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সরাসরি আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা প্রস্তাব করছি, বৃহস্পতিবারই (১৫ মে) ইস্তাম্বুলে আলোচনা শুরু হোক।'
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করে, যা ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নেয়। এতে বহু সেনা নিহত হন এবং যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ও বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
পুতিন জানান, আলোচনায় সহায়তা করতে তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে রোববারই কথা বলবেন। তবে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এখনো এই প্রস্তাবের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
রাশিয়ার দাবি, তারা বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে—এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা বন্ধে একটি প্রস্তাব, ইস্টার উপলক্ষে যুদ্ধবিরতি, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৮০ বছর উদযাপন উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টার একটি সাময়িক বিরতি। তবে ইউক্রেন প্রতিবারই এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ মস্কোর।
পুতিন বলেন, মে মাসের সাময়িক যুদ্ধবিরতির সময় ইউক্রেন রাশিয়ার ওপর ৫২৪টি ড্রোন, ৪৫টি সমুদ্র ড্রোন ও বিভিন্ন পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া পাঁচটি আঞ্চলিক আক্রমণ প্রতিহত করেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রধান দেশগুলো অভিযোগ করছে, রাশিয়াই তাদের দেওয়া যুদ্ধবিরতি বারবার লঙ্ঘন করেছে। শনিবার ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার প্রতি 'নির্বিশেষ ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির' দাবি জানিয়েছেন, নতুবা রাশিয়ার ওপর নতুন করে 'গুরুতর' নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেন।
এমন হুমকিকে 'চূড়ান্ত আল্টিমেটাম' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পুতিন।
তিনি বলেন, রাশিয়া যেসব প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলো আলোচনার টেবিলে রয়েছে, এখন সিদ্ধান্ত ইউক্রেন ও তাদের 'তদারককারীদের', যাদের কার্যক্রমের পেছনে 'নিজস্ব রাজনৈতিক অভিলাষ' রয়েছে, জনগণের স্বার্থ নয়।
পুতিন আবারও তার আগের অবস্থানই তুলে ধরেন—ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে এবং রাশিয়া অধিকৃত চার অঞ্চলের পুরো এলাকা থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সরিয়ে নিতে হবে।
মস্কো আরও চায়, যুক্তরাষ্ট্র যেন রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ডকে স্বীকৃতি দেয়। তবে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আগ্রহের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
পুতিন ২০২২ সালের যুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া একটি খসড়া চুক্তির কথাও উল্লেখ করেন। ওই চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, ইউক্রেন স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেবে, এর বিনিময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র—যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—তাদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে।
'২০২২ সালে আলোচনা রাশিয়া ভেঙে দেয়নি, বরং কিয়েভই আলোচনা থেকে সরে গিয়েছিল,' বলেন পুতিন। 'আমরা এখনো কোনো পূর্বশর্ত ছাড়া আলোচনার জন্য প্রস্তুত।'
তিনি চীন, ব্রাজিল, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
পুতিন দাবি করেন, এ যুদ্ধ কেবল ইউক্রেন ও রাশিয়ার নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এক ধরনের ছায়াযুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বারবার এই 'রক্তস্নান' বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং নিজেকে 'শান্তির দূত' হিসেবে স্মরণীয় করতে চান।
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইউরোপীয় নেতারা ও ইউক্রেনের মতে, রাশিয়ার আগ্রাসন একটি সাম্রাজ্যবাদী ভূমি দখলের চেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ এবং তারা রুশ বাহিনীকে পরাজিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
অন্যদিকে পুতিন মনে করেন, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটো সম্প্রসারণ ও ইউক্রেনসহ মস্কোর প্রভাবক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে রাশিয়াকে অপমান করেছে, আর এ যুদ্ধ সেই অপমানের প্রতিক্রিয়া।