যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করায় রুশ আক্রমণের তীব্রতা বাড়ার আশঙ্কা ইউক্রেনের

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের ফলে ইউক্রেনেরুশ আক্রমণের তীব্রতা আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কিয়েভ। একই সঙ্গে, চতুর্থ বছরে গড়ানো যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ারও আশঙ্কা করছে। খবর বিবিসির।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউস জানায়, তারা ইউক্রেনে কিছু অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেছে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ও বিভিন্ন দেশের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ভিত্তিতে 'আমেরিকার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে' এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, "সরবরাহ সংক্রান্ত সব বিষয়ে এখন দুই দেশ বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে।"
এদিকে ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে, "যেকোনো বিলম্ব শুধু আগ্রাসী রাষ্ট্রকে যুদ্ধ ও সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে, শান্তির পথে আসতে নয়।"
বিশেষ করে কিয়েভের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে মন্ত্রণালয়, কারণ প্রায় প্রতি রাতেই রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিয়েভের এক কূটনীতিককে বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে।
তবে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অস্ত্র সরবরাহ 'স্থগিত বা পুনর্বিবেচনা' করা হয়েছে—এমন বিষয়ে তারা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি পায়নি। মন্ত্রণালয়টি জনগণকে আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান না করার আহ্বান জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, যুদ্ধ শেষ করার পথ হলো "আক্রমণকারীর ওপর ধারাবাহিক ও সম্মিলিত চাপ" প্রয়োগ।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেন সবচেয়ে বড় আকাশ হামলার শিকার হয়। দেশটির বিভিন্ন শহরে ছোড়া হয়েছে ৫০০-র বেশি ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে জানাননি, ইউক্রেনে কোন কোন অস্ত্রের চালান স্থগিত করা হয়েছে।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম এনবিসি জানিয়েছে, যেসব অস্ত্র সরবরাহে বিলম্ব হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে প্যাট্রিয়ট ইন্টারসেপ্টর, হাউইটজার কামানের গোলা, ক্ষেপণাস্ত্র এবং গ্রেনেড লঞ্চার।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা চালানোর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে সামরিক সহায়তা হিসেবে শত শত কোটি ডলার পাঠিয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু সদস্য এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের মজুত কমে যাচ্ছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট দপ্তর ক্রেমলিন এ খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, কিয়েভে অস্ত্র পাঠানো কমলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার বিষয়টি দ্রুত ঘটবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, "ইউক্রেনে যত কম অস্ত্র পাঠানো হবে, বিশেষ সামরিক অভিযানের শেষ ততই ঘনিয়ে আসবে।"
ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি ফেদির ভেনিসলাভস্কি বলেন, "এই সিদ্ধান্ত কষ্টদায়ক। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে এটা খুবই হতাশাজনক অবস্থা।"
এএফপি-কে দেওয়া এক মন্তব্যে ইউক্রেনের এক সেনা সূত্র বলেছে, "আমরা মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপ চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু মার্কিন গোলাবারুদ ছাড়া আমাদের পক্ষে কাজ চালানো কঠিন হবে।"
গত তিন বছরেরও বেশি সময়ে ইউরোপীয় মিত্ররাও ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে।
তবে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের সবাই একমত নন।
চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শীর্ষ ন্যাটো কর্মকর্তা পেতর পাভেল ইউক্রেনের প্রবল সমর্থক হলেও বিবিসিকে তিনি বলেছেন, "আমি গ্যারান্টি দিতে পারি না ইউক্রেনকে গোলাবারুদ দেওয়া অব্যাহত থাকবে। এটা নির্ভর করছে চেক নির্বাচনের ফলাফলের ওপর।"
তিনি আরও বলেন, "আমি জানি না নতুন সরকারের অগ্রাধিকার কী হবে।"
পেন্টাগনের এই পদক্ষেপের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র মজুত কমে যাওয়ার উদ্বেগ রয়েছে—সিবিএস নিউজকে এমনটাই জানিয়েছেন এক সূত্র। তবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেন, "মার্কিন সেনাবাহিনীর শক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না—ইরানকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।"
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের নীতিবিষয়ক উপমন্ত্রী এলব্রিজ কোলবি এক বিবৃতিতে বলেন, "পেন্টাগন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে প্রেসিডেন্টের সামনে শক্তিশালী বিকল্প তুলে ধরছে।"
তবে তিনি যোগ করেন, "এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা আমাদের কৌশল কঠোরভাবে পর্যালোচনা ও পরিবর্তন করছি, যাতে মার্কিন সেনাদের প্রস্তুতিও সুরক্ষিত থাকে এবং প্রশাসনের প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় থাকে।"

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কি সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের একটি ন্যাটো সম্মেলনে দেখা করেন। সেখানে ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা কিছু প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দেওয়ার চেষ্টা করব কি না, তা মার্কিন কর্মকর্তারা দেখছেন।"
জেলেনস্কির সঙ্গে নিজের আলোচনার প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, "আমাদের মধ্যে আগেও কিছুটা উত্তেজনা ছিল, কিন্তু এবার সে খুবই ভদ্র আচরণ করেছে।"
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে দুই নেতার মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। এরপর ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য বাইডেন প্রশাসনের সময় নির্ধারিত সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন। একই সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও বন্ধ করে দেন। তবে পরে এই দুই সিদ্ধান্তই প্রত্যাহার করা হয়।
এপ্রিলের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যার আওতায় ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা পাবে।
এদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখো মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। দুই নেতার মধ্যে এটি ছিল আড়াই বছরেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো আলাপ, যা চলে দুই ঘণ্টারও বেশি সময়।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দপ্তর জানায়, মাঁখো ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং একটি "স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তি"র জন্য আলোচনার প্রস্তাব দেন।
অন্যদিকে ক্রেমলিন জানায়, পুতিন মাঁখোকে মনে করিয়ে দেন যে, পশ্চিমাদের নীতিই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী, কারণ তারা বহু বছর ধরে রাশিয়ার নিরাপত্তা চাহিদাকে উপেক্ষা করেছে।
গত মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি ফোরামে পুতিন বলেন, "আমি রুশ ও ইউক্রেনীয়দের এক জাতি বলে মনে করি। সেই অর্থে পুরো ইউক্রেন আমাদের।"
মস্কো বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপ।
গত কয়েক মাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখেও রাশিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে। চলতি সপ্তাহে তারা পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক অঞ্চল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেছে, যদিও এটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
রাশিয়া আরও দাবি করেছে, তারা দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের দিনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের কিছু এলাকা দখল করেছে। তবে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী এই দাবি অস্বীকার করেছে।
এদিকে মঙ্গলবার একটি ড্রোন ও রাডার তৈরি করা রুশ অস্ত্র কারখানায় ইউক্রেন হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত হয়। ঘটনাটি ঘটেছে ইঝেভ্স্ক শহরে, যা ইউক্রেন সীমান্ত থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে।