একজন নরসুন্দর ও লেখক: সেলুনেই গড়েছেন হাজার বইয়ের পাঠাগার

পুরো নাম প্রদীপ প্রোজ্জ্বল। জন্ম ১৯৮৫ সালে কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট ডোমখালীতে। বাবা ছিলেন পুলিশ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বাবা-মা কাউকেই কাছে পাননি। বড় হয়েছেন মামা আর দিদিমার (নানি) কাছে। তিন বছর বয়স থেকেই জীবনের নিষ্ঠুর এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। কাছ ছাড়া হয়েছিলেন নিজের আপনজনদের থেকেই। তাই সবসময় প্রদীপ এমন কিছু করতে চাইতেন, যা কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। মামা ছিলেন পেশায় একজন নরসুন্দর। মামার থেকে তাই কাজটা শিখে নিলেন। নিজের শেখা কাজ তো আর তাকে ছেড়ে যাবে না- এমনটাই বলছিলেন প্রদীপ!
পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ও দরিদ্রতার কারণে লেখাপড়ায় ভালো হয়েও পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি প্রদীপের। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা অবস্থায় মামার সঙ্গে সেলুনে টুকটাক হাত লাগানোর কাজ শুরু করে দেন। এর পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে পুরোপুরি এ পেশায় নেমে পড়েন।
পড়েছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত, প্রকাশিত বই ৯টি
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসে ওয়ারীতে কয়েক বছর এই কাজ করেছেন প্রদীপ। একসময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনেও (এফডিসি) কাজের সুযোগও পেয়েছিলেন। তার অনেক বন্ধু আজও সেখানে আছেন শিল্পী হিসেবে। কিন্তু প্রদীপ যাননি। কারণ, তার ওপর ছিল অনেকগুলো মানুষের দেখভালের দায়িত্ব।
এরপর প্রদীপ ঢাকা থেকে ফিরে যান চট্টগ্রামে। চকবাজারের আতুরার দোকান এলাকায় নিজের প্রথম সেলুন প্রতিষ্ঠা করেন ২০১০ সালে। নাম দেন 'অদ্বৈত হেয়ার ড্রেসার'। সেই থেকে তার জীবিকার একমাত্র উৎস এই সেলুন, যা তাকে আজও ছেড়ে যায়নি। বরং সেলুনের মাধ্যমেই নরসুন্দর ছাপিয়ে তার পরিচয় এখন অন্যকিছু!

স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও নিজের লেখাপড়া বন্ধ করেননি প্রদীপ। রবীন্দ্রনাথ স্কুল পালিয়ে হয়েছেন বিশ্বকবি, আর প্রদীপ স্কুল হারিয়ে হলেন সম্ভাবনাময়ী একজন কবি। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা প্রদীপের এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নয়টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ছয়টি। আর শিশুতোষ গ্রন্থ, উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ লিখেছেন একটি করে। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে।
সাহিত্যের মধ্যে প্রদীপের সবচেয়ে ভালো লাগে কবিতা। জীবনানন্দ দাশ আর শামসুর রাহমান তার প্রিয় কবি। কিন্তু প্রদীপ চান তার লেখায় ছাপ থাকুক সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর। জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের মতো না। একদম ভিন্ন কোনো ধারা। তাই তরুণদের বা সমসাময়িক কবিদের লেখাগুলো পড়তে ভালোবাসেন। জানাশোনার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কবিতাগুলো ইদানিং টানছে তাকে।
তবে কবিতা লেখা বা পড়া কোনোটাই চেয়ার-টেবিলে বসে নয়। হয়তো কারো মুখে শেভিং জেল মাখছেন, এর ভেতরেই হঠাৎ করে মাথায় দুটো লাইন এল, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে সেটি টুকে নিলেন। আবার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মাথার ভেতর দলা পাকতে লাগল নতুন কোনো গল্পের প্লট, ব্যস, সেটা থেকেই এগিয়ে নেন গল্পকে।
তবে একটা সময় প্রদীপ গানও লিখতেন। বন্ধুদের সঙ্গে গানের দলেও কাজ করেছেন। কিন্তু কবিতার মাঝে যে স্বাধীনতা, গানের মধ্যে তা পাননি। তাই কবিতাই লেখা শুরু করেন। তবে শুরুর দিকে লেখা গানের কলিগুলো এখনও রেখে দিয়েছেন। সামনে আবারও ইচ্ছা আছে গান লেখার।
কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আশ্রয় ছিল বই
চুল কাটা, দাঁড়ি কামানোর কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের অবসর সময়গুলোতে বই এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়েই থেকেছেন প্রদীপ। সাহিত্য বিশারদ সুহৃদ চট্টগ্রামের মতো বই ও সাহিত্যভিত্তিক নানা সংঘ এবং নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আগে থেকেই। এসব সংগঠনের সাথে থেকে নানা কর্মসূচি করতেন। কিন্তু ইচ্ছা ছিল সমাজকে আরও কিছু দেওয়ার। নিজে বই ভালোবাসতেন, ব্যক্তিগত না পাওয়া, কষ্ট, যন্ত্রণা এসব কিছু থেকে মুক্তি পেতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বইয়ের কাছেই।

বই পড়তে এতই ভালোবাসতেন যে সেলুন দেওয়ার পর সেখানেও কিছু বই রাখতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তেন। চুল কাটাতে এসে যখন কোনো গ্রাহককে সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো, নিজ থেকেই বইগুলো তুলে দিতেন তাদের হাতে। গ্রাহকরাও সময় কাটানোর একটি ভালো সুযোগ পেলেন। গ্রাহকদের জন্য এক এক করে বাসা থেকে বই নিয়ে আসতে শুরু করলেন। এভাবেই শুরু হলো তার সেলুন পাঠাগারের পথচলা।
সেলুনে গড়েছেন গ্রন্থাগার, বই এক হাজারের বেশি
শুরুতে সেলুনে নিজের পড়া বইগুলো রেখেছিলেন প্রদীপ। এখন দোকানে, বা অনলাইন শপে কোনো বই পছন্দ হলে অর্ডার করেন। আবার বিভিন্ন প্রকাশনী থেকেও বই আসে তার পাঠাগারে। সবমিলিয়ে এখন তার পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি।
ইতিহাস, কবিতা, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, রাজনীতি, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদসহ বিভিন্ন ধরনের সংগ্রহ থাকায়, সেলুনে ভিড় দেখলেও গ্রাহকরা আর বিরক্ত হন না। বরং পছন্দমতো কোনো বই নিয়ে বসে যান।

প্রদীপ জানান, পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক গ্রাহক হাতে সময় নিয়ে দুপুরের দিকে চলে আসেন। চুল কাটা, দাড়ি কামানোর পরও অনেকে বসে থাকেন হাতের বই শেষ করার জন্য। গ্রাহকের বাইরেও অনেকে বইয়ের লোভে চলে আসেন প্রদীপের সেলুনে।
তিনি বলেন, 'আশপাশের কিছু স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেরা আসে। নিজের পছন্দমতো কোনো বই নিয়ে কিছুটা সময় পড়ে, আবার চলে যায়। এরা শুধু বই পড়তে আসে।'
'এমনও কেউ কেউ আছেন, যারা ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসেন, বইয়ের সাথে অভ্যাস করানোর জন্য। আশপাশে লাইব্রেরি না থাকায় তারা এটা করেন', যোগ করেন প্রদীপ।
'প্রোজ্জ্বল পাঠাগার সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩'
বই এবং পাঠাগার নিয়ে তার আরও অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছে। তবে আপাতত ভাবছেন, বই বাসায় নিয়ে পড়তে পারার সুযোগ করে দেওয়ার। ইতোমধ্যেই কয়েকজন তরুণ এসে বই বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাই শীঘ্রই সদস্যপদ চালু করবেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানতের বিনিময়ে বই বাসায় নিয়ে পড়তে পারবেন পাঠাগারের সদস্যরা।

ছোটোবেলা থেকেই বেশ সাহসী এবং স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন প্রদীপ। নিজের অপ্রাপ্তিগুলোর জন্য কখনো দমে যাননি। বরং সাহসই দেখিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার নয়টি বই তো বেরিয়েছেই, পাশাপাশি ২০২৩ সালে তিনি তিন ক্যাটাগরিতে ছয়জন লেখকের হাতে তুলে দিয়েছেন 'প্রোজ্জ্বল পাঠাগার সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩'। তারা হলেন- গল্পকার বিপুল বড়ুয়া, কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি হাফিজ রশিদ খান, প্রাবন্ধিক মহীবুল আজিজ, আরমানউজ্জামান ও জয়ন্ত জিল্লু। সেই সাথে একটি ম্যাগাজিন পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন একই নামে।
লেখক ও নরসুন্দর এই দুই পরিচয়ে পরিচিত প্রদীপ ছোট থেকেই বইয়ের জগতে বাস করায় তার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মহল সব সাহিত্য, প্রকাশক, লেখক সাহিত্যিকদের নিয়েই। অবসরে তাদের সাথেই বিভিন্ন আয়োজন করে থাকেন নিজ সেলুনেই। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা সভার আয়োজন করে আসছিলেন প্রদীপ।
সেলুন তার জীবিকার জন্যই। কিন্তু স্বপ্ন তার পাঠাগার নিয়ে। প্রোজ্জ্বল পাঠাগারকে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন আরও বড় পরিসরে। ইতোমধ্যে নগরীর নাসিরাবাদেই তার আরেকটি সেলুনে 'প্রোজ্জ্বল পাঠগার' এর কাজ চলছে। তিন মাস আগেই তার নিজ গ্রামে দুটি পাঠাগারের জন্য বই পাঠিয়েছেন। এভাবেই জীবিকা আর স্বপ্ন দুয়ের বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

'আমার এই সেলুন আমি মনে করি একটি প্রগতিশীল, মার্জিত শুদ্ধ মানুষদের জায়গা, এখানে এমন কেউ আসবে না যাদের ব্যবহার অমার্জিত বা অরুচিকর। এখানেও গল্প আড্ডা হয় কিন্তু পরিবেশটাই এমন রাখতে চেয়েছি যেন গল্পগুলোও হয় মার্জিত, প্রাসঙ্গিক', বলেন প্রদীপ।
ছবি: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত