স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধের পর লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেড়ে গেলো ৬৭ শতাংশ

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির ব্যালার্ড হাই স্কুলের ক্যাফেটেরিয়া এখন দুপুরে রীতিমতো হইচই-এ ভরপুর থাকে। শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে গল্প করছে, হাসছে, তাস খেলছে, এমনকি কেউ কেউ বাইরের মাঠেও বেরিয়ে যাচ্ছে ছোটখাটো বিরতির জন্য। শুক্রবারে তো বিঙ্গো খেলাও শুরু হয়েছে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এই চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন।
স্কুলের প্রিন্সিপাল জেসন নয়িস বলেন, 'আগে আপনি সেখানে ঢুকলে দেখতেন সবার মাথা নিচু। সবাই শুধু স্ক্রল করছে, একে অপরের সাথে কোনো কথাই নেই।'
এই বছর লুইভিলের এই হাই স্কুলটি 'বেল টু বেল' অর্থাৎ ক্লাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করেছে। এর মানে শুধু ক্লাসের সময়ই নয়, দুপুরের খাবারের সময় বা ক্লাসের ফাঁকেও ফোন ব্যবহার করা যাবে না। কেন্টাকি এখন সেই সব রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি, যারা স্কুলগুলোতে ফোন নিষিদ্ধ করার আইন প্রয়োগ করছে।
প্রিন্সিপাল নয়িস বলেন, 'পরিবেশটাই এখন অন্যরকম। এটাকে হয়তো সংখ্যা দিয়ে মাপা কঠিন, কিন্তু আপনি যখন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলবেন, করিডোর দিয়ে হাঁটবেন বা ক্লাসে ঢুকবেন, পরিবর্তনটা চোখে পড়বেই।'
তবে যে পরিবর্তনটি সংখ্যা দিয়ে মাপা সহজ, তা হলো স্কুল লাইব্রেরির ব্যবহার। এই বছরের প্রথম মাসে, গত বছরের একই মাসের তুলনায় শিক্ষার্থীরা ৬৭ শতাংশ বেশি বই ধার নিয়েছে। যেখানে আগস্ট ২০২৪-এ ৫৩৩টি বই ধার নেওয়া হয়েছিল, সেখানে আগস্ট ২০২৫-এ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯১-এ। আর স্কুলের মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২,১৮৯ জন।
স্কুলের লাইব্রেরিয়ান স্টেফানি কনরাড বলেন, 'আমার লাইব্রেরির সহকারীরাও অবাক হয়ে বলছে, 'এ কী! এত ছেলেমেয়ে বই নিচ্ছে!''
কনরাড এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কারণ ফোন নিষিদ্ধ করা অন্যান্য স্কুলেও একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তিনি বলেন, বাচ্চারা যে এত বই পড়ছে এবং একে অপরের সাথে মিশছে, তা দেখতে সত্যিই দারুণ লাগছে।

'আগে এক বা দুই মিনিটের অবসর পেলেই বাচ্চারা ফোন হাতে নিত। ওরা যেন এক একটা মোবাইলের খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকত। একদম চুপচাপ, কারও সাথে কোনো কথা নেই,' কনরাড বলেন। আর এখনকার পরিস্থিতি? 'অসাধারণ! ওরা একে অপরের সাথে কথা বলছে, অনলাইনে একা একা থাকছে না।'
কনরাড দুই দশক ধরে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। একটা সময় ছিল যখন বাচ্চারা বই পড়ত এবং তাদের পছন্দের বই নিয়ে কথা বলতে আসত। কিন্তু মহামারির পর থেকে বাচ্চারা যেন আর বই পড়তেই চাইত না।
তিনি বলেন, 'ওরা আগে আমার সাথে বই নিয়ে কোনো কথাই বলত না। ওরা এখনকার মতো বলত না, 'ওহ, ইনি আমার প্রিয় লেখক' বা 'এই ধরনের বই আমার পছন্দ'। এখন আমি আবার শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের পছন্দের বই নিয়ে সেইসব আলোচনা করতে পারছি।'
এই বছর শিক্ষার্থীরা তাকে এমনও বলছে, ''আমি এমন একটা ফ্যান্টাসি সিরিজ চাই যেখানে মূল চরিত্র একটি ছেলে'।'
তবে ব্যালার্ড হাই স্কুলের সবাই যে এই নতুন নীতিতে খুশি, তা নয়।
দশম শ্রেণির ছাত্রী কালি ভিকার্স বলে, 'আমি প্রথমদিকে খুবই সন্দিহান ছিলাম।'
সে স্বীকার করে যে মহামারির সময় সে এবং তার সহপাঠীরা স্ক্রিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ১৫ বছর বয়সী কালি বলে, 'যেহেতু আমাদের ব্যাচটি তখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, আমরা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি শিখিনি।'

তার মতে, স্কুলে অবসরের সময় শিক্ষার্থীরা ফোনকে মন অন্যদিকে সরানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত। 'এখন যেহেতু সেই সুযোগটা নেই, আমার মনে হয় ক্লাসের মধ্যে সেই চঞ্চলতাটা বেরিয়ে আসে।'
কালি এখন বন্ধুদের সাথে বেশি কথা বলতে পারছে, কারণ তাদের মনোযোগ এখন আর ফোনে থাকছে না। তবে সে মনে করে, ফোনের বিকল্প হিসেবে লাঞ্চের বিরতির বাইরেও অন্য কোনো ব্যবস্থা থাকা উচিত।
'আমার মনে হয়, একটা ফ্রি পিরিয়ড বা বিরতির সময় থাকা উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শক্তি খরচ করতে পারবে এবং ডোপামিন পাবে,' কালি বলে। সে স্মার্টফোন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন বা লাইকের মাধ্যমে পাওয়া দ্রুত পুরস্কারের কথা উল্লেখ করে। 'আমার মনে হয়, এটা সাহায্য করবে।'
সান দিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং 'টেন রুলস ফর রেইজিং কিডস ইন এ হাই-টেক ওয়ার্ল্ড' বইটির লেখক জ্যাঁ টুয়েঞ্জি বলেন, 'এটা একটা বড় পরিবর্তন।'
তিনি আরও বলেন, '১৫ বা ১৬ বছর বয়সে কিশোর-কিশোরীরা স্বাধীনতা চায়, দায়িত্ব নিতে চায়। এর সাথে যদি তারা পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ফোন ব্যবহার করে অভ্যস্ত হয়, তবে তাদের জন্য স্কুল চলাকালীন ফোন ছাড়া থাকাটা কঠিন। মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবেই।'
টুয়েঞ্জি পড়াশোনা, সামাজিক এবং মানসিক—বিভিন্ন কারণে স্কুল চলাকালীন সম্পূর্ণ মোবাইল নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরীক্ষার নম্বর কমেছে এবং এই প্রবণতাটি মহামারি শুরু হওয়ার আগেই, অর্থাৎ স্মার্টফোন জনপ্রিয় হওয়ার সময় থেকেই শুরু হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, হাই স্কুলে সামাজিক দক্ষতা তৈরি হতে থাকে এবং বন্ধুদের সাথে দুপুরে কথা বলাটাও শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকার মানসিক স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়েও অনেক গবেষণা রয়েছে।
টুয়েঞ্জি বলেন, বাচ্চারা এখন যে ডোপামিন আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কষ্টে ভুগছে, সেটাই আসলে মূল উদ্দেশ্য। 'এটা মস্তিষ্ককে ফোন ছাড়া কিছুক্ষণ থাকার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। মনোযোগ দিতে শেখা এবং ফোন দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়া একটি খুব ভালো দক্ষতা।'

প্রিন্সিপাল নয়িস স্বীকার করেন যে এই নীতির বিরুদ্ধে কিছু প্রতিক্রিয়া এসেছে। কিছু অভিভাবক জরুরি পরিস্থিতিতে সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারার বিষয়ে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবে নয়িস যুক্তি দেন যে, সঠিক এবং স্পষ্ট তথ্য নিশ্চিত করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত থাকাই বেশি নিরাপদ।
নয়িস বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখনও দুপুরের খাবারের সময় তাদের ফোন ফেরত পেতে চাইবে, কিন্তু তিনি যা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে তারা ফোন ছাড়াই বেশি মজা করছে।
'ছাত্রছাত্রীদের সাথে সাধারণ কথা বলে আমার মনে হয়, তারা হয়তো মুখে স্বীকার করবে না, কিন্তু সম্ভবত বিভিন্ন দিক থেকে তারা এই নিষেধাজ্ঞাটির প্রশংসা করে,' নয়িস বলেন।
আর স্কুল লাইব্রেরিতে, কনরাড সেই ধরনের সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যার প্রয়োজনের কথা কালি বলেছিল।
কিছুদিন আগে দুজন নবম শ্রেণির ছাত্র লাইব্রেরিতে এসে প্রত্যেকে একটি করে বই নিয়েছিল। এখন তারা বই দুটি বদল করতে চায়।
কনরাড হাসিমুখে বলেন, 'একজন ছাত্র বলল, 'আমি এই বইটা পড়েছি এবং এখন আমি চাই ও এটা পড়ুক, আর আমি ওর বইটা পড়ব।' একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হলো, বাহ! তোমরা তো একে অপরকে বই পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছ!'
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা