বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি কি হারিয়ে যাবে?

'আমাদের স্কুলটা যেন না ভাঙে। আমরা স্কুলে আসতে চাই,' স্কুল ছুটির পর বাবা-মাকে দেখে বলে ওঠে ১৬ বছর বয়সি ঐশী।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ-এর (এনএএএনডি) ৪৪ শিক্ষার্থীর একজন ঐশী। অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এটি। ঐশী, ইসফাত সাদিক ও আনিলার মতো আরও অনেকের জন্য এই স্কুলটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন।
এখানে শিক্ষার্থীদের শুধু পড়ালেখা শেখানো হয় না, শেখানো হয় কীভাবে মর্যাদার সাথে বাঁচতে হয়। এ স্কুলে ফুল দিয়ে মালা গাঁথা, চুড়ি বানানো, ব্লক প্রিন্টের কাজ থেকে শুরু করে কম্পিউটার চালানো শিখেছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিজের কাজ করা, 'গুড টাচ-ব্যাড টাচ' শেখা—সব এখানেই তাদের।
গান, আঁকাআঁকি, নাচ ও খেলাধুলা আনন্দ নিয়ে আসে তাদের জীবনে। আর থেরাপি, কাউন্সেলিং ও শিক্ষক-অভিভাবক প্রশিক্ষণ দেয় প্রয়োজনীয় সহায়তা।
এই ছোট স্কুলটি চলে মাত্র তিনজন শিক্ষক, ছয়জন সরকারি সাইকোলজিস্ট, দুইজন সহায়ক কর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একদল স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে। ছোট পরিসরে চললেও এর প্রভাব বিশাল।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।
ঝুঁকির মুখে বেঁচে থাকার অবলম্বন
ধীরগতির কারণ দেখিয়ে মেয়োদ শেষ হওয়ার আগেই এনএএএনডি প্রকল্প সমাপ্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
১১ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। যে ভাড়া বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্পাস চালু আছে, তা নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে; কারণ বাড়িটি মালিক ডেভলপারকে দিয়ে দিয়েছেন। এরপর অস্থায়ী ক্যাম্পাসটি বন্ধ হয়ে যাবে—আর তার সাথে নিভে যাবে কয়েক ডজন পরিবারের আশার আলো।
অভিভাবকদের জন্য এই চিন্তা অসহনীয়।
শিক্ষার্থী ইসফাত সাদিকের মা নাসরিন আক্তার বলেন, 'আমার ছেলেটার ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটি আছে। এই স্কুলে ভোকেশনালে পড়ে সে হাতের কাজ শিখেছে। চারটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। স্কুলটা না থাকলে বাসায় খাবে আর ঘুমাবে। দরকার হলে তিন তলা ভবন না হোক, ছোট্ট একটা রুমে হলেও স্কুলটা চালু থাকুক।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বেসরকারি যেসব স্কুল আছে, সেগুলোর খরচ অনেক বেশি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটাই একমাত্র ভরসা।'
আরেক শিক্ষার্থীর মা সোনিয়া আক্তারও একই উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, 'আমার মেয়ে এ স্কুলে আসতে খুব পছন্দ করে। আমাদের বাচ্চারা তো স্পেশাল, ওদেরকে তো আর নরমাল স্কুলে এভাবে কেয়ার করে না। স্কুলটা না থাকলে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। বাচ্চা এখানে এসে অনেক কিছু শিখেছে; স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেলে সেসব ভুলে যাবে।'
অনেক অভিভাবক বসুন্ধরার মতো দূরের এলাকা থেকেও কেবল এই স্কুলে সন্তানকে পড়াতে নিয়ে আসেন। স্কুলটিতে তিন মাসের জন্য ফি মাত্র ১ হাজার টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই খরচে পড়ানো সম্ভব নয়।
শিশুদের আর্তি
শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পারছে তাদের ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত।
গত বছর এই স্কুলে ভর্তি হন ২০ বছর বয়সি আলিনা। এর আগে আরেকটি স্কুলে পড়েছেন তিনি, তবে তার প্রিয় এই স্কুলটা।
আলিনা গর্ব করে বলেন, 'এখানে কম্পিউটারের কাজ শিখেছি। টাইপ করতে পারি। এক্সলের কাজ শিখেছি। এরপর পাওয়ারপয়েন্টের কাজ শিখব। আমার এই স্কুলে আসতে ভালো লাগে। স্কুলটা যাতে না ভাঙে। আমি দোয়া করছি।'
একজন উদ্বিগ্ন অভিভাবক বলেন, 'এখন থেকে স্কুলে বাচ্চাকে দুদিন করে আনবো না, একদিন করে আনব। কারণ স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেলে হঠাৎ করে যদি এখানে আসা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমার ছেলেকে বাসায় রাখতে পারব না। আমরা সবাই স্কুলটা নিয়ে টেনশনে আছি।'
তাদের সবার কথায় একই আকুতি—তাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থলটি যেন বন্ধ না হয়ে যায়।
স্কুলটি চালু রাখার অনুরোধ জানিয়ে ইতিমধ্যে চল্লিশজন অভিভাবক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন।
প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা ও বাজেট সংকট
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, প্রকল্পের মূল কাজ—একাডেমিক কমপ্লেক্স নির্মাণ ১১ বছরেও শুরু হয়নি। ফলে ২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ১৬তম প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ৯৪.৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ের পর প্রকল্পটি অসম্পূর্ণ রেখেই ২০২৫ সালের জুনে সমাপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে প্রকল্পটি পরিচালনা করছে। প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৭৪.১১ কোটি টাকা, যা তিনবার সংশোধনের পর ৭৩০.৬০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। তবে প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ৯৪.৪৪ কোটি টাকা হলেও বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১৩ শতাংশ।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের জন্য আবাসিক ও আইসিটি সুবিধা প্রদান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, খেলাধুলা, সংগীত ও শিল্পের সুযোগ তৈরি করা এবং একটি শিক্ষক-অভিভাবক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা।
পরিকল্পনায় ছিল ১৫-তলা একাডেমিক ভবন, অডিটোরিয়াম, জিমনেশিয়াম, হোস্টেল, স্টাফ কোয়ার্টার, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ড্রেনেজসহ পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। পরে পরিকল্পনা সংশোধন করে একক ফাউন্ডেশনে পাঁচটি ভবনের সমন্বিত কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়, যা একক দরপত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়নে নানা জটিলতা তৈরি করেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (উন্নয়ন) মনিরা হক বলেন, 'প্রকল্পটি সমাপ্ত করে দেওয়া হয়েছে, একাডেমিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়।'