পিয়ানোর আভিজাত্য: ঢাকায় পিয়ানো কারা শেখে, কোথায় শেখে

প্রখ্যাত সুরকার গুস্তাব ল্যাঞ্জের জনপ্রিয় এক কম্পোজিশন তার ৩৯ নম্বর সুর। এর নাম দিয়েছিলেন 'ব্লুমেনলিড'। জার্মান এই শব্দের অর্থ 'ফুলেদের গান'। রায়হান চৌধুরী যখন পিয়ানো শিখছিলেন, নামটি তার খুব ভালো লেগেছিল। ২০২২ সালে যখন নিজে একটি মিউজিক স্কুল খোলার চিন্তা করেন, তখন এই নামই তিনি বেছে নেন।
'ব্লুমেনলিড মিউজিক একাডেমি' রায়হান চৌধুরী ও প্রকাশ সাহু প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল। ঢাকা শহরে পশ্চিমা যন্ত্রসংগীত শেখার স্কুল হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ নাম করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকায় কারা পিয়ানো শেখায়? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোঁজ করতে গিয়ে এ স্কুলের মতো আরও কয়েকটি নাম বারবার সামনে এল। ঢাকায় বর্তমানে এমন কিছু স্কুল রয়েছে, যেগুলো পিয়ানো সম্পর্কিত ধ্যানধারণাই বদলে দিচ্ছে।
পিয়ানো কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাঠের বিশাল এক বাদ্যযন্ত্রের ছবি- পরিপাটি সুনসান একটি কক্ষের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটিতে এর অবস্থান। আর যিনি পিয়ানো বাজাবেন, তাকে হতে হবে অভিজাত! তবে এ ধারণা যে বদলে যাচ্ছে, তা বোঝা যায় পিয়ানো শেখানোর স্কুলগুলোতে গেলে। অর্থ-বিত্ত না থাকলে পিয়ানো বাজানোর শখ করা যাবে না- এমন চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শেখার সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা এ যন্ত্রের প্রতি এখন ঝুঁকছেন ছেলে-বুড়ো সবাই।
শিখছেন যারা
সাজেদুর রহমান (২১) ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণমাধ্যম অধ্যয়নের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই গান আর বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তার আলাদা টান ছিল। স্কুলে পড়ার সময় একবার এক মিউজিক কনসার্টে পিয়ানো শুনে তার মনে হয়েছিল, এই যন্ত্র তাকে শিখতেই হবে। বাড়িতে পিয়ানো না থাকলেও ছিল একটি কি-বোর্ড। তাই দিয়েই অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখে চর্চা শুরু করেছিলেন। এখন তিনি ভালো একটি মিউজিক স্কুলের সন্ধান করছেন।
সাজেদুর জানালেন, বাড়িতে পিয়ানো না থাকলেও কি-বোর্ড বাজিয়ে তার পিয়ানো শেখা চলেছে। স্টাফ নোটেশন পড়তে শিখেছেন অনলাইনে। এখন মোৎযার্ট কিংবা বেথোভেনের সুরগুলো বাজাতে পারার ইচ্ছা দিন দিন তীব্র হচ্ছে তার। তাই স্কুলের খোঁজ করছেন। হুট করে পিয়ানো কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবে আগে শিখে নিতে চান পুরোটা।
সাজেদুরের মতো নতুন প্রজন্মের অনেকেরই পিয়ানো শেখার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রায়হান চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন এই পথে থাকায় পিয়ানো শেখার ব্যাপারে বড় এক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।
রায়হান চৌধুরীর পিয়ানোয় হাতেখড়ি ২০০৮ সালে। এরপর ২০১২ সালে 'ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল মিউজ একাডেমি'-তে কোরিয়ান শিক্ষকদের অধীনে প্রায় ৮ বছর পিয়ানো বাজানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। ২০২২ সালে শুরু করেছেন নিজেদের স্কুল।
এই দীর্ঘ পিয়ানো শেখার ও শেখানোর অভিজ্ঞতা থেকে রায়হান চৌধুরী বললেন, পিয়ানো সম্পর্কে মানুষের ধ্যানধারণা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ের উচ্চবিত্তের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন পিয়ানো শেখায় এগিয়ে রয়েছেন মধ্যবিত্তরা।
'এক সময়ের আমাদের সমাজের উচ্চবিত্তরা পিয়ানো শিখত। আমরা যখন শিখেছি, তখনো এ অবস্থা ছিল। আস্তে আস্তে পরিবর্তন এসেছে। আমি নিজে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমি শেখা শুরু করেছিলাম। এরপর নিজের স্কুলে দেখছি মধ্যবিত্তরাই শেখার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী', বলেন রায়হান চৌধুরী।
তার স্কুলেই পিয়ানো শেখে গ্রেড ১ এর শিক্ষার্থী আয়মান। তার মা দিলশাদ শারমিন জানালেন, পিয়ানো শিখবে শুধু 'এলিটরা', এটার কোনো মানে হয় না। পিয়ানো দাম এবং স্কুল সহজলভ্য হওয়ার অনেক বেশি মানুষ শেখার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রায় সব বয়সের শিক্ষার্থী তার স্কুলে পিয়ানো শিখতে আসেন বলে জানালেন রায়হান চৌধুরী। বললেন, '৬ বছরের বাচ্চা থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ, স্কুলে সব বয়সী ছাত্র আছে। আমাদের কোনো এইজ লিমিট নাই।'
পিয়ানো শেখার স্কুল

মাহনিরা মাহিক আহমেদ হুডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের গ্রেড ৭ এর শিক্ষার্থী। ছোটবেলাতেই বাড়িতে একটি কি-বোর্ড পেয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে পশ্চিমা ইন্সট্রুমেন্টের প্রতি ঝোঁক। মাহিক এখন পিয়ানো শিখছেন টিউনল্যাব মিউজিক স্কুলে।
এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্রকান্ত বিশ্বাস। তিনি গানের মানুষ। আগে থেকেই তার গানের স্কুল ছিল। নতুন করে বড় পরিসরে 'টিউনল্যাব' যাত্রা শুরু করেছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তার এই স্কুলে দক্ষ শিক্ষকেরা পিয়ানোর ক্লাস নেন বলে জানালেন তিনি। বর্তমানে একটি ব্যাচই চলছে। এখানে মাসিক ফি চার হাজার টাকা।
ঢাকায় পিয়ানো শেখানোর স্কুল খুব বেশি না হলেও সংখ্যাটি নেহাত কমও নয়। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরাতে বেশ কয়েকটি স্কুল আছে। তবে আমরা খুঁজেছি মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের মধ্যে থাকা স্কুলগুলো। এমন স্কুল পাওয়া গেল উত্তরায়।
'ব্লুমেনলিড মিউজিক একাডেমি'র শাখা তিনটি। উত্তরায় প্রধান কার্যালয়। এছাড়া মিরপুর ও গুলশানে স্কুল রয়েছে তাদের। বর্তমানে তিনটি ব্যাচে পিয়ানো শেখানো হয়। সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস নেওয়া হয়। বেসিক ব্যাচ চার মাসের, ফি প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা। ইন্টারমিডিয়েট ও অ্যাডভান্স ব্যাচ ৬ মাস করে, মাসিক ফি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
এবিআরএসএম পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে স্কুলটি। ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্বীকৃত সনদ মেলে শিক্ষার্থীদের।
'প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ধরে ধরে শেখানো হয়। ইন্ডিভিজুয়াল ক্লাস প্রোভাইড করি আমরা। ফলে শেখাটা ভালো হয়', বললেন স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশ সাহু।
প্রাইভেট স্কুল ছাড়াও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ঢাকায় পিয়ানো শেখায়। তাদের অন্যতম ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ। তিনটি আলাদা কোর্স রয়েছে তাদের। মাসে চারটি করে ক্লাস হয়। ফি প্রতি মাসে চার হাজার টাকা। প্রায় একই ধরনের পিয়ানো কোর্স অফার করে ইয়ামাহা আর্ট সেন্টার বাংলাদেশ। তেজগাঁওয়ে তাদের পিয়ানো শোরুম। সেখানেই পিয়ানোর ওপর ক্লাস নেন দেশের স্বনামধন্য পিয়ানোবাদকেরা।
যে কারণে পিয়ানো

টিউনল্যাব স্কুলের ব্যপস্থাপক সজীব জানান, এটি শেখার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বেশির ভাগই পিয়ানো শেখেন নিছক শখের বশে। এক্ষেত্রে কাজ করে বিদেশি কার্টুন ও চলচ্চিত্রের প্রভাব। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা সিনেমা বা অ্যানিমেশনে পিয়ানোর সুর শুনে এই যন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
বন্ধুদের সামনে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করার উদ্দেশে অনেকে পিয়ানোর ক্লাসে ভর্তি হন। তবে তাদের সংখ্যা কম। তাদের কাছে পিয়ানো শেখা এক ধরনের স্ট্যাটাস বা পরিচিতির মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে।
তবে এসবের বাইরে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি জানা যায়, তা হলো অ্যাকাডেমিক ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। অনেক শিক্ষার্থী পিয়ানো শেখেন অতিরিক্ত দক্ষতা হিসেবে। বিশেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা স্কলারশিপের ক্ষেত্রে সংগীত শেখার অভিজ্ঞতা বাড়তি সুবিধা এনে দেয়, এমনটি মনে করেন পিয়ানো স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।

সাগর কুমার সাহার মেয়ে পিয়ানো শিখছেন। তিনি জানালেন, শৈশবে তিনি যত ধরনের খেলাধুলার সুযোগ পেয়েছেন, বর্তমান প্রজন্ম তা পাচ্ছে না। অভিভাবকদের দায়িত্ব তাদের সন্তানদের বিভিন্ন কিছু শেখার সুযোগ করে দেওয়া। তাই তিনি পিয়ানো বেছে নিয়েছেন। এ দক্ষতা তার সন্তানের অ্যাকাডেমিক জীবনে কাজে লাগবে বলে মনে করেন তিনি।
রায়হান চৌধুরী বলছেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পিয়ানো শেখার ক্ষেত্রে বিদেশি স্কলারশিপ একটি বড় 'মোটিভেশন' হিসেবে কাজ করে। ফলে পিয়ানো এখন শুধুই বিনোদন নয়, বরং শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
পিয়ানোর কেমন দাম
ইয়ামাহা মিউজিক বাংলাদেশে নিজস্ব পিয়ানো বিক্রি করে থাকে। তাদের কাছে ডিজিটাল এবং অ্যাকোস্টিক, দুই ধরনের পিয়ানো পাওয়া যায়। ডিজিটাল পিয়ানোর দাম শুরু হয়েছে ৬০ হাজার থেকে। গ্রান্ড পিয়ানোগুলোও ডিজিটাল ভার্সনে পাওয়া যায় তাদের শোরুমে। সেগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি। এছাড়া রয়েছে অ্যাকোস্টিক পিয়ানো। সবচেয়ে দামি অ্যাকোস্টিক পিয়ানোর পাওয়া যায় ৩৫ লাখ টাকায়।
ইয়ামাহা মিউজিক স্কুলের হেড অব অপারেশন ফারহান ইশরাক জানালেন, ডিজিটাল পিয়ানোর দাম কিছুটা কম হওয়াতে মানুষ এটি সহজেই কিনতে পারছে। ফলে পিয়ানো শেখাও সহজ হয়ে উঠেছে।

গোল্ডেন মিউজিকের দুটি শাখা রয়েছে ঢাকায়, ধানমন্ডি এবং গুলশানে। ভালো মানের বাদ্যযন্ত্র বিক্রিতে তাদের সুনাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তন্ময় সরকার জানালেন, ঢাকা শহরে পিয়ানো বিক্রিতে অন্যতম বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান তারা। নাক্স, কার্যওয়েলের মতো সব ব্রান্ডের পিয়ানো, কি-বোর্ড তাদের কাছে পাওয়া। তারা বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড পার্লরিভারের অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর।
তন্ময় সরকার বলেন, '১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায় ভালো মানের কি-বোর্ড পাওয়া যায়। ডিজিটাল পিয়ানোর দামও আগের তুলনায় অনেক কম। ফলে মধ্যবিত্তদের মধ্যে পিয়ানো কেনার পরিমাণ বেশি। সামনে আরও বাড়বে।'
যদিও গত এক বছরে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র কেনাতেই ভাটা পড়েছে, তবুও আশাবাদী তিনি।
ছবি: জুনায়েত রাসেল