ভিসা জটিলতা যেভাবে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভোগাচ্ছে

বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রাফিয়া তাবাসসুম (ছদ্মনাম) গত বছর স্নাতক শেষ করেছেন। চলতি বছরের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি হওয়ার অফার লেটার পান তিনি। কিন্তু ভিসার সাক্ষাৎকারের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে সময় নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন রাফিয়া, কারণ শুরুতে কোনো তারিখ পাওয়া যাচ্ছিল না।
পরে মে মাসে আবার চেষ্টা করলে সাত মাস পর ডিসেম্বরে সাক্ষাৎকারের সময় পান রাফিয়া। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ এটি অনেক দীর্ঘ অপেক্ষা। অপ্রত্যাশিত এই দেরির কারণে রাফিয়াকে ভর্তি স্থগিত করে পরবর্তী সেমিস্টারে নিতে হয়েছে।
শুধু রাফিয়াই নন, ভিসা সাক্ষাৎকারের সময় পেতে এ ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী।
ভোগান্তি এখানেই শেষ নয়। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভিসা-সংক্রান্ত নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন, দেশে-বিদেশে দুই জায়গাতেই। ভিসার তারিখ পেতে দেরি হওয়া থেকে শুরু করে বিদেশে গিয়ে হঠাৎ ভিসা বাতিল হওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
আরাফাত হোসেন (ছদ্মনাম) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। দেড় বছর ধরে তিনি সেখানে বসবাস করছিলেন এবং মাস্টার্স ডিগ্রির প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শুধু চূড়ান্ত পরীক্ষাই বাকি ছিল।
কিন্তু এক সকালে তিনি ই-মেইলে জানলেন, মার্কিন ফেডারেল সরকার তার শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল করেছে। দ্রুত দেশ ছাড়ার নির্দেশও দেওয়া হয় তাকে। হঠাৎ করেই জীবনের কঠিন সংকটে পড়লেন তিনি, ভেঙে যায় তার সব স্বপ্ন।
এটি কল্পনা করা বা বোঝা কঠিন হতে পারে। কিন্তু ঠিক এভাবেই ঘটনাগুলো ঘটছে, এবং তা অনেকটা নীরবেই।
আরাফাত বলেন, 'সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো—তারা আসল কারণটিও স্পষ্ট করে জানায় না।' তার দাবি, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমানে আরাফাত বাংলাদেশে আছেন এবং পিএইচডি করার সুযোগ খুঁজছেন। তবে ভিসা বাতিলের রেকর্ড থাকার কারণে তা এখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে।
অ্যারাফাত একা নন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ফক্স নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশি শিক্ষার্থী ও অভিবাসীদের ওপর কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও আছেন।
একজন কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, বাতিল হওয়া ভিসার মধ্যে প্রায় ৪ হাজারের ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গের অভিযোগ ছিল। এসবের মধ্যে রয়েছে হামলা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, চুরি এবং 'সন্ত্রাসবাদে সমর্থন'-এর মতো অভিযোগ।
এ ঘটনাকে ঘিরে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন নুসরাত নাজনীন ইভা। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লক্ষ্য ২০২৬ সালের 'ফল সেশন' (শরৎকালীন সেশন)। তবে ভিসা প্রত্যাখ্যানের ভয় তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।
নুসরাত বলেন, 'যেদিকেই তাকাই, দেখি শিক্ষার্থী ভিসার নিয়ম আরও কঠোর হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। এতে ভয় লাগে। জানি না, বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে কি না। শুধু ভালো কিছুর আশাই করতে পারি।'
তবে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ইভার মতো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থেমে নেই। বরং আরও বেশি করে তারা বিদেশে ভালো সুযোগের খোঁজে যেতে চাইছে।
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গেছেন। ২০০৮ সালে যেখানে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ হাজারের মতো, সেখান থেকে বেড়ে গত বছর পৌঁছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
২০২৪ সালের সঠিক পরিসংখ্যান এখনও জানা যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সেখানে পড়াশোনা করেছে ১৭ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। এটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যা। আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার অন্যতম বড় কারণ। দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ায় বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে।
নুসরাত বলেন, 'দেশে শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ খুবই কম। এটাই আমাদের বিদেশে যাওয়ার মূল কারণ। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন, সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা চলছে। মানসিকভাবে এটি ভীষণ ক্লান্তিকর। মনে হয় এখানে থাকার আর কোনো মানে নেই। আমি শুধু দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই।'
শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার কারণ কেবল শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল নয়। শ্রম ভিসা, পর্যটক ভিসা ও অন্যান্য ভিসা কড়াকড়িও ধাপে ধাপে প্রভাব ফেলছে; শিক্ষার্থীদেরও প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশিরা এখন অভূতপূর্ব ভিসা জটিলতার মুখোমুখি। উপসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপসহ নানা স্থানে ভিসা প্রত্যাখ্যান বেড়েছে বলে আগেই টিবিএসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। ভিয়েতনাম, লাওস, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর ভারত ও থাইল্যান্ডসহ কিছু দেশ কঠোর শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়ায়। সেখানে বাংলাদেশি স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ। কারণ হিসেবে নিয়োগ জালিয়াতি, ভুয়া নথি ও শ্রম অস্থিরতার বিষয় উল্লেখ করছে দেশগুলো।
তবে এই ঘটনার ভিন্ন কিন্তু সত্য একটি দিকও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনার জন্যও গিয়েছেন। তাহলে সমস্যার মূল কোথায়?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দিয়েছেন আহনাফ চৌধুরী নিলয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার যাত্রা অনেকের কাছে ব্যতিক্রম মনে হতে পারে।
আহনাফ বলেন, 'আমার ভাগ্য সহায় ছিল। মার্কিন ভিসা পাওয়ার মাত্র ৭ দিন পরই ভিসা প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই তখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে সমস্যায় পড়েন। সৌভাগ্যবশত আমার প্রক্রিয়াটা খুব সহজেই সম্পন্ন হয়, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রাতেও কোনো সমস্যা হয়নি।'
তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী স্কলারশিপের সংখ্যা কমেছে, অথচ আবেদনকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। এটি এক ধরনের নেতিবাচক সম্পর্ককে প্রকাশ করে। তবুও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আহনাফের পর্যবেক্ষণ, এখানে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় তথ্য ছড়ানো হয়, যা শিক্ষার্থীদের উপকারের বদলে আতঙ্ক বাড়ায়। তার মতে, ফান্ডিংয়ের সুযোগ আগের তুলনায় কম হলেও এটি তেমন কঠিন নয়, যেমনটি সাধারণভাবে বলা হয়।
আহনাফ বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, অনেকেই আমাকে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অধ্যাপকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। এই ধারণা থেকে এক শিক্ষার্থী তার পিএইচডি শুরু করার লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন ২০২৭ সালের শেষ দিকে। তবে তার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। অধ্যাপকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ার শুরুটা হয়েছিল শুধু একটি ই-মেইল দিয়ে।'
তিনি বলেন, 'এরপর ভর্তি চিঠি পাওয়ার আগেই আমার হাতে চলে আসে ফান্ডিংয়ের প্রস্তাব। হাতে সময় ছিল খুব কম। দ্রুত নথিপত্র তৈরি করতে হয়, আর ভিসার জন্য আবেদন করি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাই। সহপাঠী ও সিনিয়রদের সঠিক পরামর্শে জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্টের আবেদন করে দ্রুত ভিসা নিশ্চিত করতে সক্ষম হই।'
স্কাইলার্ক ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী তাহিয়া তালবিয়া মিম ছয় বছর ধরে শিক্ষা পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'ভিসা অনুমোদনের হার কমলেও আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আগের চেয়ে বেশি মানুষ বাইরে যাওয়ার কথা ভাবছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক দেশ নিজেরাই ভিসা প্রক্রিয়ায় ফিল্টারিং শুরু করেছে। মানদণ্ড অনেক উঁচু করা হয়েছে। পাশাপাশি তারা নিজেদের কর্মসূচি ও বৃত্তি নিয়ে ব্যাপক প্রচারণাও চালাচ্ছে। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেশি আবেদন করছেন, যাদের ভিসা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই কম।'