ব্যাংক কোম্পানি আইন: পারিবারিক পরিচালকের সীমা তুলে দেওয়া, ৯ বছর মেয়াদের প্রস্তাব বিএবি-র

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকস (বিএবি) প্রস্তাবিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ২০২৫ সংশোধনীর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। সুপারিশে তারা শেয়ারহোল্ডারদের অংশগ্রহণ বাড়ানো ও পরিচালনা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করার মতো সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার 'পরিবার'-এর সংজ্ঞা শুধু স্বামী-স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার আহ্বান জানান।
পাশাপাশি, একই পরিবারের শেয়ার ধারণের সর্বোচ্চ সীমা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো এবং একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ করার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
বিএবির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাঠামো নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্যামেলস, সাস্টেইনেবিলিটি, রিস্ক রেটিং ও পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করতে হবে।
'এতে ভালো ব্যাংক পুরস্কৃত হয়ে আরও উন্নত হবে এবং দুর্বল ব্যাংক কঠোর কাঠামোর মাধ্যমে সংস্কারে বাধ্য হবে' উল্লেখ করে বিএবি বলেছে, এর ফলে ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ননির্ভর আইন বাস্তবসম্মত, ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তুলবে।
বর্তমান আইনে পরিবার বা পরিবারের সদস্য অর্থ কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন ও উক্ত ব্যক্তির ওপরে নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি।
বিএবি বলেছে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পরিবারের সংজ্ঞা তুলনামূলকভাবে সীমিত ও বাস্তবমুখী। যেমন ভারতে পরিবার কেবল স্বামী-স্ত্রী বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবার। পাকিস্তানে স্বামী-স্ত্রী, নির্ভরশীল সরাসরি বংশধর ও নির্ভরশীল ভাইবোন। শ্রীলঙ্কায় পরিবার শুধু স্বামী-স্ত্রী বা নির্ভরশীল সন্তান।
শেয়ারধারণের সীমা
বিএবি প্রস্তাব করেছে, ব্যাংকের শেয়ারধারণে বর্তমান ১০ শতাংশ সীমা বাতিল করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার রাখার অনুমতি দেওয়া হোক।
সংগঠনটির মতে, উচ্চমাত্রার শেয়ার মালিকদের মধ্যে মালিকানা বোধ, দায়িত্বশীলতা ও সুশাসন জোরদার করে। কারণ ব্যাংক দুর্বল হলে তাদের নিজস্ব পুঁজি ঝুঁকিতে পড়ে। এতে ব্যাংকের স্থিতিশীলতা, দক্ষতা ও মুনাফা বাড়ে। বিপরীতে কঠোর সীমাবদ্ধতা থাকলে বিনিয়োগকারীরা পরোক্ষভাবে শেয়ার সংগ্রহে উৎসাহিত হয়, যা তদারকিকে জটিল করে তোলে।
ভোটাধিকার
বর্তমান আইনে শেয়ারহোল্ডারদের ভোটাধিকারের ওপরে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি একটি ব্যাংকের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হলেও তারা সব শেয়ারহোল্ডারের মোট ভোটের ৫ শতাংশের বেশি প্রয়োগ করতে পারবেন না।
বিএবি এই সংশোধনীটি পুরোপুরি বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। তাদের যুক্তি হলো: বর্তমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে শেয়ারহোল্ডারদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তারা তাদের ধারণকৃত শেয়ারের অনুপাতে ভোট দিতে পারেন, যা কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ সালের 'এক শেয়ার, এক ভোট' নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পর্ষদ গঠন ও পরিচালক-সংক্রান্ত বিধান
বর্তমান ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একই পরিবারের তিনজনের বেশি সদস্য একই সময়ে কোনো ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের খসড়া সংশোধনীতে এই সীমা কমিয়ে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন সদস্যের কথা বলা হয়েছে।
তবে বিএবি এই সীমা তুলে দেওয়া বা শিথিল করার প্রস্তাব করেছে। তাদের যুক্তি হলো, যদি সতর্কতার সাথে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়, তবে পরিচালনা পর্ষদে আরও বেশি ব্যাংকের প্রতি মনোযোগী ও অঙ্গীকারসম্পন্ন পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা
বর্তমান আইনে প্রতিটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকতে পারেন, যেখানে অন্তত ২-৩ জন হতে হবে স্বতন্ত্র পরিচালক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এই সংখ্যা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ জন পরিচালক রাখা হয়েছে এবং শর্ত দেওয়া হয়েছে যে মোট পরিচালকের অন্তত ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র হতে হবে।
বিএবি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছে, স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা আগের নিয়ম অনুযায়ীই (ন্যূনতম ২, সর্বোচ্চ ৩) রাখা উচিত।
সংগঠনটির যুক্তি, অর্ধেক স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলে শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ন্ত্রণ কমবে, বাস্তব অভিজ্ঞতা হ্রাস পাবে এবং ব্যাংক পরিচালনায় মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির চেয়ে কেবল নীতিপালন অগ্রাধিকার পাবে।
অন্য ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়
বর্তমান আইনে এক ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারের অন্য ব্যাংকের শেয়ারধারণে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, একই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা পরিবারের সদস্যরা একাধিক ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য শেয়ার রাখতে পারবেন না; তারা অন্য ব্যাংকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ শেয়ার রাখতে পারবেন।
বিএবি এই প্রস্তাব বাতিলের সুপারিশ করেছে। তাদের মতে, এ বিধান বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগ সীমিত করবে, দুর্বল ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হবে এবং বাজার তারল্য কমবে।
আন্তর্জাতিকভাবে এমন সীমাবদ্ধতা কেবল একটি ব্যাংকের অভ্যন্তরে প্রযোজ্য, গোটা খাতে নয়। পাশাপাশি এটি সংবিধানের ব্যবসা ও সম্পত্তির অধিকারের পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করেছে বিএবি।
পরিচালকের মেয়াদ
বর্তমান আইন অনুযায়ী, একজন ব্যাংক পরিচালক সর্বোচ্চ ১২ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং মেয়াদ শেষে ৩ বছর বাদে পুনঃনিযুক্ত হতে পারেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এই মেয়াদ কমিয়ে ৬ বছর করা হয়েছে।
বিএবির মতে, এটি খুব সীমাবদ্ধ, তাই পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের যুক্তি, দীর্ঘমেয়াদি ও অভিজ্ঞ পরিচালকদের ধারাবাহিকতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও কৌশলগত নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেয়াদ কমালে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও নেতিবাচক বার্তা সৃষ্টি হতে পারে।
খেলাপি ঋণের কারণে পরিচালকের পদে শূন্যতা
বর্তমান আইনে একজন ব্যাংক পরিচালক কোনো ঋণগ্রহীতা, জামিনদাতা বা বন্ধকদাতা হিসেবে ঋণের সাথে যুক্ত থাকলে তাকে সেই ঋণের জন্য দায়ী করা যায়। খেলাপি হওয়ার কারণে পদ শূন্য হলে এক বছরের জন্য তার পুনঃনিয়োগ নিষিদ্ধ থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে পরিচালককে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের জন্যও দায়ী করা হয়েছে এবং শূন্য পদের ক্ষেত্রে ৩ বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
বিএবি এই প্রস্তাব বাতিলের সুপারিশ করেছে এবং ৩ বছরের পরিবর্তে ৬ মাসের সীমা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।
পরিচালক নিয়োগ
বর্তমান আইন অনুযায়ী, একজন ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক একই সময়ে অন্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন না।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এই বিধিনিষেধ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বিএবি মনে করে, এই নিয়মটি অত্যন্ত কঠোর। তাই এই সীমাবদ্ধতা শুধু অন্যান্য ব্যাংক কোম্পানির পরিচালকদের জন্য প্রযোজ্য করার সুপারিশ করেছে।
বিএবির মতে, এতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পরিচালকদের ব্যাংকিং খাতে অংশগ্রহণ সহজ হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় থাকবে। পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদের কাঠামোর স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে।