১৭ মাস পর ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি আবারও দুই অঙ্কে
টানা ১৭ মাস পর ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে ফিরেছে। চলতি বছরের আগস্ট মাস শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০২ শতাংশে।
এর আগে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়জুড়ে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল এক অঙ্কে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকে আবারও আমানত বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার হ্রাস।
তারা বলছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদ কমে যাওয়ায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগ কমিয়ে ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ করছে। তিন মাস আগেও ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ছিল ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে; অক্টোবর নাগাদ তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশের ঘরে।
ব্যাংকাররা জানান, বর্তমানে ট্রেজারি বিল–বন্ড ও ব্যাংক আমানতের সুদের হার প্রায় সমান। তবে গত তিন মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ২০০ বেসিস পয়েন্টের বেশি কমে যাওয়ায় এই খাতে বিনিয়োগ কমেছে, যা ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী বলেন, "ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদের হার কমছে। এজন্য অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান নতুন করে এ খাতে বিনিয়োগ করছে না। ফলে তারা ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ করছে।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদের (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) পরিমাণও কমেছে। এর বড় একটি অংশ আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদের হার কমায় অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ শুরু করেছে।"
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, "কিছুদিন আগে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তখন আমানত কমে গিয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা ফিরেছে। ফলে এখন আমানত বাড়ছে।"
তিনি বলেন, "রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকায় অর্থনীতিতে টাকার সঞ্চালন বেড়েছে। মানুষের যদি ব্যাংকের ওপর আস্থা থাকে, তারা ব্যাংকেই সঞ্চয় রাখে। মাঝখানে আস্থার সংকট তৈরি হলেও ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে ব্যাংক খাত।"
সোহেল আর কে হুসেইন আরও বলেন, "ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ার অন্যতম কারণ ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদের হার হ্রাস পাওয়া। দুই খাতের সুদের হার প্রায় সমান হয়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো নতুন করে ট্রেজারি বিল–বন্ডে বিনিয়োগ করছে না। এর আগে যখন সুদের হার ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন সবাই ওই খাতের দিকেই ঝুঁকেছিল, যা তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য আরও সমস্যার তৈরি করেছিল। এখন আবার ব্যাংকে টাকা আসা বাড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনেছে, এতে বাজারে তারল্য আগের চেয়ে বেড়েছে।"
বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদের হার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নিলাম অনুযায়ী ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ৬০ শতাংশে।
এছাড়া ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার যথাক্রমে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এক বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনেছে। এতে ব্যাংক খাতে আগের তুলনায় তারল্য বেড়েছে। ১৫টি নিলামের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২ বিলিয়নের বেশি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।"
তিনি আরও বলেন, "সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমায় ব্যাংক আমানত এখন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক সুদহার ও উদ্ভাবনী পণ্যও আমানতের প্রবাহ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।"
ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদের (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ কমেছে। আগস্টে এ পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার একটি অংশ আবার ব্যাংকে ফেরত আসছে। তবে সব অর্থই যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফিরে আসছে, তা নয়।"
