আমদানি ও বিনিয়োগে সতর্কতা, অক্টোবরে এলসি খোলা কমেছে ১২ শতাংশ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য এবং ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছরের অক্টোবরে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশেরও বেশি কমেছে, যা অর্থনীতিতে আমদানির চাহিদা হ্রাস ও নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতার প্রতিফলন।
২০২৫ সালের অক্টোবরে ৫.৬৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এলসি খোলা কমেছে ১২.১৫ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৬.৩১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
এদিকে এলসি নিষ্পত্তি, অর্থাৎ আগে খোলা এলসির বিপরীতে অর্থ পরিশোধের হারও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪৮ শতাংশ কমেছে। গত বছরের অক্টোবরে এলসি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল ৬.১০ বিলিয়ন ডলার, যা এ বছরের অক্টোবরে কমে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এলসি খোলা কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। অনেক আমদানিকারক রমজানের ভোগ্যপণ্যের জন্য বছরের শুরুতেই এলসি খুলে রেখেছেন, এজন্য অক্টোবরে সেটার চাপ খুব একটা বেশি ছিল না। এছাড়া শীতের আগে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) চাহিদাও সাধারণত কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, 'রোজার জন্য যা যা ভোগপণ্য আনা দরকার, তা আগেই আনা হয়েছে। তাছাড়া এসব পণ্যের জোগান দেশে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সেজন্য অক্টোবরে এলসি খোলার চাপ খুব একটা বাড়েনি।
'তাছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। ডলারের কোনো ধরনের সংকট কিংবা দামে অস্থিরতা নেই।'
মিডল্যান্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আহসান-উজ জামানও একই ধরনের মত প্রকাশ করে বলেন, 'রোজার জন্য যা আমদানি করা হয়, তা আগেই করা হয়েছে, এজন্য এ মাসে কিছুটা আমদানি কমেছে। তাছাড়া সবসময় যে বেশি পরিমাণ এলসি খোলা হবে এমনও নয়, মাঝেমধ্যে সরকারি বড় বড় এলসি খোলা হয়।'
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন, সরকারি এলসি খোলা আগের মতোই রয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি খুব একটা বেশি বাড়েনি। 'আর এলএনজি আমদানির এলসি খোলা শীতের আগে কমে যায়। এজন্যও এলসি খোলা কমেছে,' বলেন তিনি।
পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তাও টিবিএসকে বলেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানির এলসি খোলা কম থাকবে। সেপ্টেম্বরেও এলএনজির এলসি খোলা কমেছে।
তাছাড়া অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করছেন, সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও দেশে নতুন বিনিয়োগ কমছে।
আখতার হোসেন বলেন, 'দেশে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। তাতে সামগ্রিকভাবে আমদানি এলসি খোলা কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।'
আহসান-উজ জামান বলেন, 'সামনে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো হলে বিনিয়োগ বাড়বে। তখন দেশের অর্থনীতির অবস্থাও আগের চেয়ে ভালো হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।'
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানও অনেকটা একই সুরে বলেন, 'দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে বিনিয়োগ বাড়বে, তখন আমদানির এলসি খোলা আগের চেয়ে বাড়বে। বর্তমানে অনেক বড় গ্রুপের এলসি খোলা কমেছে। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানে বন্ধ থাকা অনেক প্রতিষ্ঠান আবার এলসি খোলা শুরু করবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে নিট ইক্যুইটি (নতুন বিনিয়োগ) দাঁড়িয়েছে ৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের একই প্রান্তিকে ছিল ২১৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় নিট ইক্যুইটি কমেছে ৬২ শতাংশ।
চলতি বছর সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। কারণ নতুন বিনিয়োগ কমলে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমতে থাকে।
বাণিজ্য লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারির কারণে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধ হওয়ার জন্য অক্টোবরে এলসি খোলা কমেছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আগে বেশি এলসি খোলা হতো, তবে এর পেছনে অর্থ পাচারও হতো। আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থ পাচার এখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে।
'আগে বেশি পরিমাণে এলসি খোলা হতো, তখন দেখানো হতো যে চাহিদা বেড়েছে। আসলে চাহিদার কথা বলে বড় অংশের অর্থ দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। তবে এখন আগের থেকে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ লেনদেনের সুযোগ কমে যাওয়ায় এলসি খোলার হারও কমেছে,' বলেন তিনি।
