রপ্তানিকারকরা পাবেন দ্রুত পেমেন্ট, গ্লোবাল ইনভয়েস ডিসকাউন্টের অনুমতি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের আর ৩–৪ মাস অপেক্ষার পর বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে ইনভয়েস পেমেন্ট নিতে হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব শিগগিরই তাদের জন্য বৈশ্বিক ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে, ফলে দ্রুত নগদ অর্থ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতা-স্বীকৃত ইনভয়েস আপলোড করতে পারবেন। ক্রেতার ঋণযোগ্যতা যাচাইয়ের পর বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইনভয়েসগুলো কেনার জন্য দর দিবে। এরপর রপ্তানিকারকরা ইনভয়েসের প্রকৃত অর্থের চেয়ে কিছুটা কম অগ্রিম অর্থ নিতে পারবেন—কয়েক মাস অপেক্ষার ঝামেলার পরিবর্তে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো পণ্য বাকিতে বিক্রির পর ক্রেতার বিলম্বে অর্থ পরিশোধ (ডেফার্ড পেমেন্ট)। অনেক ক্রেতাই তাদের সুনাম ব্যবহার করে রপ্তানিকারকের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিতে চায়। পণ্য পাঠানোর পর আমদানিকারকের কাছ থেকে তার মূল্য পেতে রপ্তানিকারককে ১২০ দিন পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। এসময় রপ্তানিকারককে তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালাতে, নতুন অর্ডার নিতে, বেতন দিতে এবং উৎপাদন খরচ মেটাতে নগদ টাকার প্রয়োজন পড়ে।
এদিকে রপ্তানি বিলের বিপরীতে স্থানীয় ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঋণ সবাইকে দিচ্ছে না বা বেশিরভাগক্ষেত্রে রপ্তানিকারক এই ঋণ সুবিধা অনুযায়ী পান না। "বছরের পর বছর ধরে রপ্তানিকারকরা উন্নত সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এই প্ল্যাটফর্মগুলো সেই চাহিদা পূরণ করবে"– যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ব্যাংকগুলোও এই ব্যবস্থায় যুক্ত হবে। "এই সার্কুলার জারির সকল কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে, শিগগিরই তা জারি করা হবে। সর্বোচ্চ ডিসকাউন্ট রেট নির্ধারণ করা হবে সোফর+৪, অর্থাৎ প্রায় ৮ শতাংশ, যাতে কোনো রপ্তানিকারককে এর বেশি ডিসকাউন্ট দিয়ে বিল নগদায়ন করতে না হয়।"
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) -এর চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "এটা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ফ্যাসিলেটেশন মেজার্স। বাংলাদেশের ট্রেড ফাইন্যান্স মেকানিজম নতুন একটি উইন্ডো পাবে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াবে। ফলে উদ্যোগটি ভালো।" তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এটি পুরোপুরি কার্যকর হতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। পোশাক খাতের বাইরের যেসব রপ্তানিকারকরা আছেন, তারাও যাতে সুবিধা নিতে পারেন, সেই উদ্যোগ থাকতে হবে।
ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্ম যেভাবে কাজ করে
ট্রেড ফাইন্যান্স ডিসকাউন্টিং মূলত একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে রপ্তানিকারকরা তাদের প্রাপ্য ইনভয়েস (রিসিভেবলস) অগ্রিম অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে পারেন। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি হলো—রপ্তানিকারক তার পাওনা অর্থ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ডিসকাউন্টে হস্তান্তর করে সঙ্গে সঙ্গে নগদ অর্থ সংগ্রহ করেন।
রপ্তানিকারক পণ্য পাঠানোর পরে আমদানিকারক বা ক্রেতার ইস্যু করা ইনভয়েস অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপলোড করেন। প্ল্যাটফর্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা আমদানিকারকের ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারকের ক্রেডিট রেটিং যাচাই করে। এরপর আমদানিকারকের রেটিং অনুযায়ী, ইনভয়েসের বিপরীতে বিভিন্ন ফাইন্যান্সার যেমন ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। রপ্তানিকারককে ইনভয়েসের প্রকৃত অর্থের চেয়ে কিছুটা কম অর্থ অগ্রিম দেওয়া হয়।
যেমন এক লাখ ডলারের ইনভয়েসের বিপরীতে রপ্তানিকারক ৯৭ হাজার ডলার আগাম পেতে পারেন। বা তার চেয়ে আরও কম বা বেশি হতে পারে। এটি নির্ভর করে আমদানিকারকের রেটিং ও বিল পরিশোধের নির্ধারিত দিন বা ম্যাচুরিটির কত আগে সেটি ডিসকাউন্টিং করা হচ্ছে তার ওপর। নির্ধারিত সময়ে আমদানিকারক সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করলে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান তাদের অগ্রিম অর্থ ফেরত পায়।
এই ব্যবস্থায় রপ্তানিকারকরা ব্যাংক ঋণ ছাড়াই দ্রুত অর্থ পেয়ে উৎপাদন চালু রাখতে ও নতুন অর্ডার সম্পন্ন করতে পারেন। অন্যদিকে, বিদেশি ক্রেতার ক্রেডিট ঝুঁকি বহন করে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সক্রিয় কিছু ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে আছে: মার্কো পোলো নেটওয়ার্ক (জার্মানি), কমগো (সুইজারল্যান্ড), কনটোর (সিঙ্গাপুর), ট্রেড লেন্স (ডেনমার্ক/যুক্তরাষ্ট্র), বোলেরো (যুক্তরাজ্য), ইএসএসডকস (মাল্টা), ইনকমলেন্ড (সিঙ্গাপুর), উই.ট্রেড (ইইউ) এবং ট্রেডস (ভারত)।
বর্তমান অর্থায়নের ঘাটতি
সোনালী ব্যাকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রপ্তানি আদেশের বিপরীতে স্থানীয় ব্যাংকগুলো প্রি-শিপমেন্ট ফাইন্যান্স ও ব্যাক টু ব্যাক ফাইন্যান্স করে থাকে। এই দুই ধরনের অর্থায়নে রপ্তানি বিলের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করা হয়ে থাকে। তবে পোস্ট-শিপমেন্ট অর্থায়ন যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলো নগদ রপ্তানি আদেশে সর্বোচ্চ আট কার্যদিবস পর্যন্ত বিনা সুদে অর্থায়ন দিতে পারে। আর ডেফার্ড এলসির ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল রেটে অর্থায়ন করা হয়। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের কমার্শিয়াল রেট ১৩.২৫ শতাংশ।"
ওই ব্যাংকার বলেছেন, এ ধরনের প্লাটফর্মে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ থাকা দরকার। স্থানীয় ব্যাংকের হাতে অনেক সময় গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা থাকে না। ফলে বিকল্প অর্থায়নের উৎস থাকলে সেটি গ্রাহকের জন্য ভালো হবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি)-তাদের এক প্রকাশনায় বলেছে, বৈশ্বিক ট্রেড ফাইন্যান্সের চাহিদা প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এ ধরনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ডিজিটাল ট্রেড ফাইন্যান্স ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্মগুলো এই ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কিছু ডিসকাউন্টিং সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে এইচএসবিসি ও প্রাইম ব্যাংক সীমিত আকারে ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং ও রিসিভেবল ফাইন্যান্সিং সেবা দিচ্ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আয়ের বড় অংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত পণ্য, পাট ও পাট পণ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি হয়। ব্যাংকাররা বলছেন, মোট রপ্তানির অর্ধেক বা তার বেশি হয়ে থাকে ডেফার্ড এলসি বা বাকিতে।
সুবিধা ও ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রেড ফাইন্যান্স ডিসকাউন্টিংয়ের গ্লোবাল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হলে রপ্তানিকারকরা দ্রুত নগদ টাকা পাবে, যা দিয়ে নতুন অর্ডার নিতে, উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। যেসব ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণ পেতে সমস্যা হয়, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারকরা—সহজেই গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে অর্থায়ন পাবে। স্থানীয় ব্যাংকের তুলনায় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক ডিসকাউন্ট রেট-ও পাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি রপ্তানিকারককে বিদেশি ক্রেতার ক্রেডিটের ঝুঁকি বহন করতে হবে না।
তবে এক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে বিদেশি অর্থায়নকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। দেশের ব্যাংকগুলো যদি সক্রিয়ভাবে অংশ না নেয়, তাহলে রপ্তানিকারকরা বিদেশি বিনিয়োগকারী ওপর অতি-নির্ভরশীল হয়ে যাবে। ফলে এমনকি এই ব্যবস্থার সুবিধা পাওয়াও কঠিন হতে পারে।
রপ্তানিকারকদের এই প্ল্যাটফর্মে ইনভয়েস আপলোড, কাগজপত্র ও ক্রেতার তথ্য সঠিকভাবে দিতে হবে। দুর্বল রেকর্ড-রাখার কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা নিতে পারবে না। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ কিছুটা কমতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে নিশ্চিত করতে হবে যেন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় কোনো চাপ না পড়ে।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান টিবিএসকে বলেন, "ডেফার্ড পেমেন্ট এখন প্রথায় দাঁড়িয়েছে। আগে ২১ দিনের মধ্যে পেমেন্ট মিললেও এখন ১০৫ দিন পর্যন্ত গড়াতে পারে। অথচ রপ্তানিকারককে ব্যাক টু ব্যাক এলসির অর্থ আগেই পরিশোধ করতে হয়, অনেক সময় ক্রেতাদের কাছ থেকে পেমেন্ট না পেয়েই। তাই ইনভয়েস ডিসকাউন্টিংয়ের বিষয়টি এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক ডিসকাউন্টিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়া বাড়তি সুবিধা দেবে। "তবে এর সুফল অনেকটাই নির্ভর করবে বাংলাদেশের পণ্যের ক্রেতাদের ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর। যদি প্রতিযোগিতামূলক ডিসকাউন্ট রেট না পাওয়া যায়, তাহলে প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হলেও লাভ হবে না।"
বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম টিবিএসকে বলেন, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। দেশের ব্যাংকগুলো রপ্তানি বিলের বিপরীতে অর্থায়নে যে ধরনের নীতি অবলম্বন করছে, তাতে রপ্তানিকারকদের একটি অংশের এ ধরনের সুবিধা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, অনেক ক্রেতা ৬০ দিন বা ৯০ দিন ডেফার্ড পেমেন্ট চায়। পণ্য বিক্রির স্বার্থে সেটি দিতে বাধ্য হন রপ্তানিকারকরা। এদিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির পেমেন্টের সময় হয়ে গেলে তখন ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়। ব্যাংক সবাইকে ঋণ দিতে চায় না। আবার যাকে দিচ্ছে তার থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয়। এরকম পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারক তার বিল ডিসকাউন্ট করে ২ বা ৩ দিনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা পেলে তার জন্য অনেকটাই সুবিধা হবে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর টিবিএসকে বলেন, এটি খুবই ভালো ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। আরও আগেই নেওয়া দরকার ছিল। "আমেরিকান বায়ারসহ অন্যান্য অনেক দেশের ক্রেতারা তাদের দেশের বন্দরে বা তাদের গোডাউনে পণ্য পৌঁছানোর ৩০ থেকে ৯০ দিন পরে পেমেন্ট করার শর্তে পণ্য কেনে। এই শর্তে পণ্য রপ্তানি করতে না চাইলে ক্রেতারা অন্য দেশ বা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য নিতে চলে যায়। ফলে বাকিতে বিক্রির শর্ত মেনে নিয়েই রপ্তানি করতে হয়।
"এরকম পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ডিসকাউন্টিং সুবিধা রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। রপ্তানিকারকদের সক্ষমতার জন্য পেমেন্ট টার্মস একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে খেয়াল রাখতে হবে এই ডিসকাউন্টিং কস্ট যাতে বেশি না হয়" - তিনি যোগ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও মুহাম্মদ এ (রুমী) আলী বলেছেন, "এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ডিসকাউন্টিংয়ের জন্য বড় মার্কেটে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে দেশের বাজারেও এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং থাকতে হবে।"