মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাসে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১১ শতাংশ

ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও, চলতি বছরের আগস্টে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি কমে গেছে। এর মূল কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস, যা নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগে মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্টে আমদানি দায় নিষ্পত্তি কমে ৪.৮৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ৫.৪৮ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১০.৯৪ শতাংশ।
তবে আগস্টে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ৩.০৬ শতাংশ বেড়ে ৫.৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫.২২ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মাসগুলোতে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমে যাওয়া ও ওভারডিউ এলসির চাপ কম থাকার কারণে আগস্টে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে। তাছাড়া দেশে নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগ কমেছে। এ কারণে এখন কাঁচামাল বা মূলধনী যন্ত্রপাতির চেয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বেশি আগ্রহী ব্যবসায়ীরা।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, বিনিয়োগ কমলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও কমে যায়। 'বর্তমানে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন কম। তাছাড়া বর্তমানে ডেফারড [বিলম্বিত] এলসিগুলোর মেয়াদও আর বাড়ানো হচ্ছে না,' বলেন তিনি।
বিনিয়োগে মন্দার প্রভাব
পলিসি থিঙ্ক অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. মাজেদুল হক বলেন, 'ভোগ্যপণ্য ছাড়া সেভাবে এলসি খোলা হচ্ছে না। বিনিয়োগ কম, তাই কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির চাহিদাও কম। বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমেছে, নতুন বিনিয়োগ নেই ও ব্যাংকঋণের সুদহারও উচ্চ। এ বাস্তবতায় ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানি স্বাভাবিকভাবেই কম।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে, তাই সেখানে এলসি নিষ্পত্তি কমেনি। 'মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ায় এলসি নিষ্পত্তি কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি যে কম, তা বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি দেখলেই বোঝা যায়। কারণ প্রবৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ১১.৫ শতাংশ কমেছে।
এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান বলেন, 'মূলত আগে এলসি কম খোলা হওয়ার কারণে নিষ্পত্তি কমেছে। ২০২৪ সালের শেষের দিকে ও চলতি বছর শুরুর দিকে এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কম ছিল। এজন্য এখন নিষ্পত্তি কমে গেছে।'
ডলার সংকট থেকে স্থিতিশীলতা
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের ডলারের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন এলসি খোলার ওপর মার্জিন আরোপ করে। এরপর পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে এলসি নিষ্পত্তিতে ওভারডিউয়ের মতো সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায় ব্যাংকগুলো।
২০২৪ সালের দেশের শিল্প-বাণিজ্য গতিশীল করতে বিলাসজাতীয় ও বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্য ছাড়া সব ধরনের আমদানিতে এলসি মার্জিন তুলে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন থেকে ব্যবসায়ীরা সব ধরনের মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য, ও কাঁচামাল ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো ধরনের নগদ মার্জিন ছাড়া আমদানি করতে পারছেন।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
মো. মাজেদুল হক সতর্ক করে বলেন, বিনিয়োগ কমে গেলে বেকারত্ব আরও বাড়তে পারে। তাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ ডলার সরবরাহ রয়েছে, তাতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি করতে কোনো ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে নতুন বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা যায়।'