সাংহাই র্যাঙ্কিং: শীর্ষ ৫০০-তে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন-তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি

বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে এবার ঘটেছে এক বিরাট পরিবর্তন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো 'সাংহাই র্যাঙ্কিং'-এর সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দিয়েছে চীন ও তাইওয়ান। বিশ্বজুড়ে সেরা ১,০০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়, আর এবারের ফলাফল যেন র্যাঙ্কিংয়ের দুনিয়ায় এক নতুন যুগের সূচনা করল।
অন্যদিকে, স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গতবারের মতো এবারও ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় জায়গা পেলেও উন্নতি করতে পারেনি। উল্টো, ভ্যালাডোলিড বিশ্ববিদ্যালয় তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে, আর তার জায়গায় এসেছে লাস পালমাস ডি গ্রান ক্যানারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
এই র্যাঙ্কিংয়ের নাড়িনক্ষত্র বোঝেন এমন একজন হলেন গণিতবিদ ডোমিঙ্গো ডোক্যাম্পো। তিনি বলেন, "ব্যাপারটা অনেকটা আর্কিমিডিসের সূত্রের মতো। চীন তরতর করে ওপরে উঠছে, তাই র্যাঙ্কিংয়ে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার প্রতিষ্ঠান কমবে, এটাই স্বাভাবিক।" তিনি আরও যোগ করেন, "এশিয়ার এই পরাশক্তি অনেক বছর ধরেই উচ্চশিক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ করছে এবং বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।"
কীভাবে নির্ধারিত হয় এই র্যাঙ্কিং?
সাংহাই র্যাঙ্কিংয়ের স্কোর নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর। যেমন—কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক বা প্রাক্তন শিক্ষার্থী নোবেল পুরস্কার বা ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন, কতজন গবেষকের আর্টিকেল বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হয়েছে, এবং গত পাঁচ বছরে 'সায়েন্স' ও 'নেচার'-এর মতো শীর্ষস্থানীয় জার্নালে কতগুলো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গবেষকদের সাইটেশন বা উদ্ধৃতির বিষয়টি খুব পরিবর্তনশীল, ফলে র্যাঙ্কিংয়ে ওঠানামা চলে খুব দ্রুত।
এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আয়তনে বিশাল। ফলে তাদের গবেষণার সংখ্যাও বেশি এবং নামকরা জার্নালগুলোতে প্রকাশ করা বহুল উদ্ধৃত গবেষকের সংখ্যাও প্রচুর। ডোক্যাম্পোর মতে, চীনের একমাত্র দুর্বলতা হলো নোবেল বিজয়ীর সংখ্যায় পিছিয়ে থাকা, কারণ দেশটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জগতে দেরিতে প্রবেশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুর্দিন কি শুরু হলো?
একদিকে যখন চীন শিক্ষায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, তখন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে নেওয়া নানা নীতির কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত মে মাসে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডকে বিদেশি ছাত্র ভর্তিতে বাধা দেয়, যা প্রায় ৬,৮০০ শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলও ঝুঁকিতে পড়েছে।
যেমন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ মিলিয়ন ডলার, পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০ মিলিয়ন ডলার (ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া কার্যক্রমে রাখায় শাস্তি হিসেবে), এবং হার্ভার্ডের ৯ বিলিয়ন ডলারের তহবিল আটকে দেওয়া হয়। এমনকি গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদের জেরে কর্নেল এবং নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলও "ইহুদি-বিদ্বেষ মোকাবিলার" নামে স্থগিত করা হয়।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবং গবেষণার অর্থায়ন কমতে থাকলে, সাংহাই র্যাঙ্কিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড ও এমআইটি তালিকার শীর্ষে থাকলেও এবার তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে অন্যরা। শীর্ষ ২০টির মধ্যে ১৫টি যুক্তরাষ্ট্রের, তিনটি যুক্তরাজ্যের, একটি ফ্রান্সের এবং একটি এশিয়ার—চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যা ২২তম স্থান থেকে লাফিয়ে ১৮তম স্থানে উঠে এসেছে!
স্পেনের যত আক্ষেপ
স্পেনের ফলাফলকে বলা যায় 'মিশ্র'। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাঙ্কিংয়ে টিকে থাকলেও তাদের স্কোর আগের চেয়ে কমেছে। এর একটি বড় কারণ অর্থায়ন। স্পেন যেখানে উচ্চশিক্ষায় জিডিপির মাত্র ০.৭% খরচ করে, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় প্রায় ১.২%। স্পেনের সবচেয়ে ধনী অঞ্চল মাদ্রিদ, অথচ তারাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে কম, মাত্র ০.৫% বিনিয়োগ করে।
এতসব চ্যালেঞ্জের পরেও স্পেনের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল দিকও রয়েছে। দেশটির কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ১০০-তে না থাকলেও, তাদের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে বেশ দক্ষ হিসেবেই দেখা হয়। স্পেনে মোট ৯১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০টি সরকারি, যার ৭২% সাংহাই র্যাঙ্কিংয়ের তালিকায় রয়েছে। এর মানে হলো, স্পেনের যেকোনো শিক্ষার্থী চাইলেই তার বাড়ির কাছাকাছি একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়—সেটি হার্ভার্ড না হলেও মানের দিক থেকে পিছিয়ে নেই।