ভর্তি ও একাডেমিক পরিকল্পনায় ত্রুটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিভাগে ফাঁকা থাকছে আসন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি বিভাগ সব আসন পূরণ করতে পারেনি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয় ও শিক্ষার্থীদের চাহিদার মধ্যে তফাত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
জুলাইয়ের শুরু থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে গেলেও বিশেষ করে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের অনেক আসন ফাঁকা পড়ে আছে। সাতবার বিষয় পরিবর্তনের (মাইগ্রেশন) পরও উর্দু, ফারসি, সংস্কৃত ও পালি বিভাগের মতো বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার খুবই কম।
এছাড়া বিজ্ঞান ইউনিটভুক্ত লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির মতো কারিগরি বিভাগেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন ফাঁকা রয়েছে। আবার বিজ্ঞান ইউনিটের অন্যান্য বিভাগে শিক্ষার্থীরা ভর্তিপরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক নম্বরের শর্ত পূরণ করতে না পারায় উল্লেখযোগ্য আসন ফাঁকা রয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ টিবিএসকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকতে পারে না, এটা নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে।'
শিক্ষার্থী ভর্তি সংকট এড়াতে তিনি 'বাজার চাহিদার' সঙ্গে সমন্বয় করে আসন সংখ্যা নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তির যোগ্যতা পূরণ করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক ন্যূনতম নম্বর নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ শুধু মেধাক্রমে থাকলেই হবে না, বরং নির্দিষ্ট কিছু বিষয় পেতে হলে বিষয়ভিত্তিক নির্দিষ্ট নম্বরও পেতে হয়। বিজ্ঞান ইউনিটের পদার্থবিজ্ঞান, ফলিত রসায়ন ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে ভর্তি হতে বিষয়ভিত্তিক ন্যূনতম নম্বরের শর্ত রয়েছে। অনেক আবেদনকারী নির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম নম্বর না পাওয়ায় বিভাগগুলো আসন পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এ বছর ঢাবির ৬ হাজার ১৩০টি আসনের মধ্যে ৫০৫টি আসন ফাঁকা রয়েছে।
চলতি বছর বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাশের হার ছিল মাত্র ৫.৯৩ শতাংশ। ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৯৪ জন ভর্তিচ্ছুর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ৭ হাজার ৪৩৭ জন পরীক্ষার্থী। ফলিত রসায়ন বিভাগে ৬০টি আসনের মধ্যে ভর্তি হতে পেরেছেন ৩২ জন। ইইই বিভাগে ৭৫ আসনের মধ্যে অন্তত ৫২টি ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ১০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৬৫টি আসন পূরণ হয়েছে।
শুধু উচ্চ জিপিএ থাকাই যথেষ্ট নয়; শিক্ষার্থীদের বিভাগীয় শর্তও পূরণ করতে হয়। অধ্যাপক রশিদ বলেন, 'গত দুই দশকে সরকারগুলোর মধ্যে একটি ধারণা কাজ করেছে—বেশি পাশের হার ও উচ্চ জিপিএ মানেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য। প্রকৃত অর্থে, আমরা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ওভারমার্কিং করছি।'
'তার প্রতিফলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ফলাফলে, এখানে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করছে। আবার যারা পাশ করেছে, তারা বিভাগভিত্তিক ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতে পারছে না,' বলেন তিনি।
একজন শিক্ষকও একই উদ্বেগের কথা জানান: 'শিক্ষার মান অনেক কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা কোয়ালিফাইং মার্কই পাচ্ছে না।'
আগ্রহ কমায় সংকটে ভাষাভিত্তিক বিভাগগুলো
কলা অনুষদের ভাষাভিত্তিক বিভাগগুলো বারবার মাইগ্রেশনের সুযোগ দেওয়ার পরও গত তিন বছর ধরে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। এ বছর উর্দু বিভাগে ৩৫টি, ফারসিতে ২১টি, সংস্কৃতে ৩৭টি ও পালিতে ২২টি আসন ফাঁকা রয়েছে। গত বছরও ক্লাস শুরুর পরও এই বিভাগগুলোতে অন্তত ৬১টি আসন শূন্য ছিল; ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এই সংখ্যা ছিল ১২৯।
সুমাইয়া আফরিন (ছদ্মনাম) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে আবার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভর্তি বাতিল করেন। তিনি পরের সেশনে বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ছেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ফারসি বিষয় নিয়ে আমার সমস্যা ছিল না, সাহিত্য আমার ভালোই লাগত। কিন্তু আমার পরিবার, বিশেষ করে নিকটাত্মীয়রা এই বিষয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তাই তাদের উদ্বেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি আবার পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হই।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিভাগগুলো শিক্ষার্থীদের পরিবর্তনশীল আগ্রহ বা চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বিভাগগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। চীনা, জাপানি, ফরাসি ও ভাষাবিজ্ঞানের মতো অন্যান্য ভাষাভিত্তিক বিভাগেও আসন ফাঁকা রয়েছে।
শিক্ষার্থী সংকটে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট
ইন্সটিটিউট অভ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ১৫০ আসনের মাত্র ৫৩টি আসন পূরণ হয়েছে। এর মধ্যে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৫০টি আসনের মধ্যে ১৭ টি, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২৯টি ও লেদার প্রোডাক্ট বিভাগে ৫০টি আসনের মধ্যে ৪১টি আসনই ফাঁকা রয়েছে।
ইনস্টিটিউটটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, 'অন্যান্য অনেক বিভাগের তুলনায় আমাদের বিষয়গুলোর চাকরির বাজার ও অ্যালামনাই পারফরম্যান্স ভালো। কিন্তু হয়তো শিক্ষার্থীরা সেভাবে ফিল করে না। আবার হতে পারে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাভাবনায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল চাকরিতে আগ্রহ কম। গত বছরও এ সংকট ছিল। যখন আবার নতুন করে বিষয় মনোয়ন দেওয়া হয়, তখন আমরা কিছু শিক্ষার্থী পেয়েছিলাম।'
ব্যবহারিক ও জনপ্রিয় বিভাগেও আসন ফাঁকা
সংগীত ও নৃত্যকলার মতো যেসব বিভাগে ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, সেখানেও বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে। এ বছর সংগীত বিভাগের ৬০ আসনের মধ্যে ৩৬টি ও নৃত্যকলা বিভাগের ৩০ আসনের মধ্যে ১১টি আসন শূন্য রয়েছে। গত বছরেও এ দুটি বিভাগে মোট ২৭টি আসন ফাঁকা ছিল।
বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের অন্যান্য বিভাগেও সংখ্যায় অল্প হলেও আসন ফাঁকা থাকার খবর পাওয়া গেছে। ভূতত্ত্ব, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ভূগোল, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এবং টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফির মতো নতুন বিভাগগুলোতেও আবেদনের সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও সবগুলো আসন পূরণ হয়নি।
নীতিগত দুর্বলতায় আসন ব্যবস্থাপনায় সংকট
গত দুই বছরের ভর্তির ধারা থেকে স্পষ্ট যে, মাইগ্রেশনের ব্যবস্থা থাকার পরও নির্দিষ্ট কিছু বিভাগ ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। ভর্তির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা বলছেন, ভর্তির যোগ্যতা শিথিল করা বা আরও মাইগ্রেশনের সুযোগ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান হবে না।
এ ধরনের পদক্ষেপে শিক্ষার্থীরা কম পছন্দের বিভাগে যেতে বাধ্য হতে পারে, যা ভারসাম্যহীনতা আরও বাড়িয়ে দেবে। ঢাবিতে বর্তমানে ক্লাস শুরু হওয়ার পর বিষয় পরিবর্তনের সুযোগ নেই, যদিও এটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শেষ। কাজেই নতুন করে বিষয় বরাদ্দ দিলে যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।
ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, 'আমাদের সব ধরনের উদ্যোগ, প্রচেষ্টার পরও কিছু আসন সবসময় ফাঁকা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবিক অর্থ কিছু করার নেই।'
ঢাবির অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শূন্য থাকা আসনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য শীঘ্রই উপাচার্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির সভা করার কথা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাবির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪টি বিভাগ ও ১৩টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে অনেকগুলোরই চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাসন সংকট, শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা, পরিবহন সমস্যা ও গ্রন্থাগার সুবিধার ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে।
ড. মনিনুর রশিদ বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণা থাকা দরকার, যা নির্ধারণ করবে আমাদের কী ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন, আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, কী পরিমাণ রিসোর্স রয়েছে এবং এর মাধ্যমে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব।'