দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার্থীদের নিতে আগ্রহী বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চোখ এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার্থীদের দিকে। গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া সরকার ঘোষণা করেছে, তারা বিদেশি শিক্ষার্থীর কোটা ৯ শতাংশ বাড়িয়ে ২ লাখ ৯৫ হাজারে উন্নীত করবে। এই বাড়তি কোটায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবেদনকারীদের।
অন্যদিকে, জাপান ২০৩৩ সালের মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ২০২৭ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩ লাখে নিয়ে যেতে চায়। তাইওয়ানের সরকার গত বছর ঘোষণা দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতে শ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে তারা প্রতিবছর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী আনতে চায়।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আকুমেন-এর ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ভিয়েতনামী শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনা করছেন, যা বিদেশে অধ্যয়নরত মোট দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ শতাংশ। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং থাইল্যান্ড থেকে এই সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার।
আকুমেন-এর তথ্যমতে, ২০২২ সালে চীন ও ভারতের পর বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে তৃতীয় বৃহত্তম অঞ্চল ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, যেখান থেকে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করতে গেছেন।
মেধা খুঁজছে ইউরোপ
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘস্থায়ী তহবিল সংকট এবং জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করছে। তারা বুঝতে পারছে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসী কর্মী প্রয়োজন। একারণে তাদের দৃষ্টিও এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে।
এ বছরের জুন মাসে, হ্যানয়ে অবস্থিত জার্মান দূতাবাস ভিয়েতনামে একটি "ক্যারিয়ার ট্রাক" পাঠায়। এর উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিতে পড়াশোনার সুযোগ সম্পর্কে তরুণদের জানানো। এর ঠিক এক মাস আগে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ হ্যানয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রাষ্ট্রীয় সফরে মূল বক্তব্য দিয়েছিলেন।
এদিকে, জুলাই মাসে ব্রাসেলসে এক বক্তৃতায় ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো আরও বেশি ইন্দোনেশীয় নাগরিককে ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় ৩,৩০০ ইন্দোনেশীয় শিক্ষার্থী ইউরোপে পড়াশোনা করেন।
তবে এত আগ্রহের পরও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব এখনও অনেক কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে অধ্যয়নরত ১৬ লাখ ৬০ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মধ্যে খুব সামান্য একটি অংশই এই অঞ্চলের। জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিসের (ডিএএডি) তথ্যমতে, জার্মানিতে স্নাতক পর্যায়ে প্রায় ৭,০৬০ জন ভিয়েতনামী শিক্ষার্থী রয়েছেন।
সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজের ইউরোপ-দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্পর্ক প্রকল্পের প্রধান আলফ্রেড গার্স্টল বলেন, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সত্ত্বেও, ইউরোপীয় শিক্ষাঙ্গনে এই অঞ্চলটি নিয়ে এখনও তেমন কোনো আলোচনা নেই।"
আর্থিক চাপে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়
ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। মে মাসে, যুক্তরাজ্যের অফিস ফর স্টুডেন্টস এক প্রতিবেদনে জানায়, এ বছর ইংল্যান্ডের ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ঘাটতিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জার্মানিতে, বাজেট সংকটের কারণে ডিএএডি ফেব্রুয়ারিতে ২,৫০০টি স্কলারশিপ বাতিল করে। ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তহবিলও ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে। ফ্রান্সের ২০২৫ সালের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে আগের বছরের তুলনায় ১ বিলিয়ন ইউরো (১.১৫ বিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিভার্সিটি অ্যালায়েন্সের মার্চ মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন তহবিল স্বল্পতার এক 'নতুন বাস্তবতার' মুখোমুখি হচ্ছে। খরচ বাড়ছে, কিন্তু আয় এক থাকছে। একারণে বহু প্রতিষ্ঠান এখন আরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তির দিকে ঝুঁকছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, "যেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি (নন-ইইউ) শিক্ষার্থীদের জন্য ফি নির্ধারণ করতে পারে, সেসব দেশে এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার জন্য শক্তিশালী প্রণোদনা কাজ করছে।" গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, প্রয়োজনীয় আয় বাড়াতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি একটি 'গুরুত্বপূর্ণ উপায়' হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে।
ইউরোপ কীভাবে আরও শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে পারে?
২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চেক প্রজাতন্ত্রের পালাকি ইউনিভার্সিটির ক্রিস্টিনা কিরোনস্কা সামরিক জান্তার হাত থেকে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ফেলোশিপ জোগাড় করতে সাহায্য করছেন।
তিনি জানান, অনেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নামকরা অনুদান পেলেও তাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল ভিসা এবং বসবাসের অনুমতি সংক্রান্ত কাগজপত্র জোগাড় করা। তিনি বলেন, ইউরোপীয় সরকারগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাগরিকদের জন্য ভিসা এবং দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা করে প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করতে পারে।
তবে সমাধানের পথটা যেন বারবার অর্থেরই কাছে ফিরে আসে।
সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজের আলফ্রেড গার্স্টল বলেন, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আরও বেশি শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে হলে শিক্ষা বিনিময় এবং বৃত্তির জন্য আরও বেশি তহবিল সরবরাহ করতে হবে, বিশেষ করে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য।"
বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নিজেদের নীতিতে পরিবর্তন আনছে। জুলাই মাসে, নরওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নরওয়েজিয়ান ভাষার প্রয়োজনীয়তা শিথিল করেছে এবং আন্তর্জাতিক পিএইচডি প্রার্থীদের জন্য চাকরির পথ সহজ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি বাড়ানোর পর ভর্তির হার মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় তারা সেই ফি সংশোধন করেছে।
মে মাসে, ইউরোপীয় কমিশন 'চুজ ইউরোপ ইনিশিয়েটিভ' নামে ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর একটি প্রকল্প চালু করেছে, যার লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে শীর্ষ গবেষকদের আকর্ষণ করা। এর মধ্যে ইউরোপীয় গবেষণা পরিষদের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অনুদান সম্প্রসারণ এবং স্থানান্তরিত গবেষকদের জন্য টপ-আপ অনুদান দ্বিগুণ করার মতো উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পূর্ব এশিয়ার নতুন আকর্ষণ
তবে এমন কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনার জন্য এখন নিজেদের অঞ্চলের কাছাকাছি দেশগুলোর দিকেই বেশি তাকাচ্ছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। এর পরিবর্তে, তারা এখন নিজেদের অঞ্চলের দেশগুলোকেই বেছে নিচ্ছে।
বর্তমানে যেকোনো ইংরেজিভাষী দেশের চেয়ে জাপানে ভিয়েতনামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এশিয়াজুড়ে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এই পরিবর্তনের একটি বড় কারণ। ২০২৪ সালে, কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পূর্ব এশিয়ার ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে, যা ২০১৫ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার মাঝে সুযোগ
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন একাডেমিক ফান্ডিং এবং শিক্ষার্থীদের চলাচলের ওপর আরও কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে।
জানা গেছে, ফুলব্রাইট অনুদান ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়েছে, যার ফলে ৭,৪০০ জনেরও বেশি বিদেশি গবেষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হোয়াইট হাউস কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০০ মিলিয়ন ডলার তহবিলও কেটে দিয়েছে। হাজার হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেলেও, সরকারিভাবে এর কোনো সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়নি।
মার্চ মাসে, 'নেচার' পত্রিকার একটি জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিজ্ঞানীদের তিন-চতুর্থাংশই দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।
অনেক ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতাশ আমেরিকান শিক্ষাবিদদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেও, কেউ কেউ মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থার এই অস্থিরতাকে এশিয়ার, বিশেষ করে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করার সুযোগ হিসেবে দেখছে।