বাটা: আমাদের জুতা পরতে শিখিয়েছে যে ব্র্যান্ড, জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গেও

'ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান, সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন।'
এটা ১২৬ বছর বয়সি জুতার ব্র্যান্ড বাটার বিজ্ঞাপন। ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে বাটানগর নিউজে প্রকাশিত হয়েছিল এই বিজ্ঞাপন। সে সময় বাংলার গ্রাম-গঞ্জের মানুষের পায়ে জুতার দেখা পাওয়া ছিল দুর্লভ ঘটনা। শহর বা মফস্বলেও জুতা পরার চল তেমন ছিল না। একজোড়া জুতা দিয়েই বছর কাটিয়ে দিত সবাই। এখনকার মতো একগাদা ব্র্যান্ড, হরেক রকমের ডিজাইনও ছিল না। সে সময় মজবুত, টেকসই জুতা মানেই ছিল বাটা। ডিজাইনের চাকচিক্যের চেয়ে জুতো কতদিন টিকবে, এ নিয়েই চিন্তা ছিল বেশি। ধুলো-ময়লা থেকে পা বাঁচাতে সস্তা ও মজবুত জুতা দরকার ছিল। আর সে চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব পালন করত বাটা। কোম্পানিটি কীভাবে উপমহাদেশের মানুষের জুতা পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে অবদান রেখেছে, তারই সাক্ষী ওপরের ট্যাগলাইন।
'বাটা' নামটা শুনলেই কত-শত স্মৃতি এসে ঠোকর মারে আমাদের মাথায়। জীবনের কোনো পর্যায়ে এই ব্র্যান্ডের জুতো পরেনি, এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
একসময় প্রতি বছর নতুন ক্লাস শুরুর আগে ছেলেমেয়েরা বাটা দোকানে যেত পিটি ক্লাসের জন্য জুতা কিনতে। আরেক প্রজন্মের মানুষের হয়তো বাটার 'নটি বয়' জুতার কথা মনে আছে। এই জুতা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল দীর্ঘদিন টিকত বলে। ১৯৯০-এর দশকের দিকে জন্ম নিয়েছেন যারা, তাদের হয়তো 'ফার্স্ট টু বাটা দেন টু স্কুল' ট্যাগলাইনের কথা মনে আছে। স্কুল শ্যু থেকে আধুনিক ক্যাজুয়াল জুতা—এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাটার নাম।
শুরুর গল্প
বাটার যাত্রা শুরু ১৮৯৪ সালের ২৪ আগস্ট, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের মোরাভিয়ায়। টমাস বাটা তার ভাই অ্যান্টোনিন ও বোন অ্যানাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন টি. অ্যান্ড এ. বাটা'স শ্যু কোম্পানি।
টমাস বাটার পরিবার ছিল বংশপরম্পরায় মুচি। ছোট থাকতেই বাবার থেকে দেখে দেখে জুতো সেলাই শিখে নিয়েছিলেন বাটা। সর্বক্ষণ নানা আইডিয়া গিজগিজ করত তার মাথায়। সবসময় চাইতেন ডিজাইনে নতুনত্ব আনতে। সেই ইচ্ছা থেকেই খোলেন বাটা কোম্পানি।
নিজেই জুতো সেলাই করতেন টমাস বাটা। উৎপাদন কম হলেও জুতো টেকসই হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল তার কোম্পানি। ধীরে ধীরে পসার বাড়তে লাগল। কিন্তু ১৮৯৫ সালে তার ভাই অ্যান্টোনিন চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। বিয়ে হয়ে গেল বোন অ্যানারও। একা একা কীভাবে টি. অ্যান্ড এ. বাটাকে বাঁচানো যায় ভাবতে শুরু করলেন টমাস বাটা।

১৯০৪ সালে কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মীকে নিয়ে নতুন ডিজাইন শেখার জন্য পশ্চিমের দেশগুলোতে ঘুরতে বেরোলেন টমাস। মেশিনে জুতো তৈরির কৌশল শিখে নিলেন শিগগিরই। অল্প সময়ে জুতো তৈরির কৌশল শিখে ফিরলেন দেশে। এবার নতুন ধরনের জুতো বানিয়ে কম দামে বাজারে ছাড়লেন। হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল কোম্পানির নাম। বিক্রি বাড়ল ঝড়ের গতিতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য জুতো বানানোর ফরমায়েশ পেলেন টমাস। তাঁর টি. অ্যান্ড এ. বাটা কোম্পানির নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতি ভেঙে পড়ল। লোকসানে পড়ে গেলেন টমাস। কিন্তু হাল ছাড়লেন না তিনি। বলতে গেলে কোনো লাভ না রেখেই দাম কমিয়ে জুতো বিক্রি করতে লাগলেন। বিক্রির সঙ্গে বাড়ল টমাসের নামডাকও। কোম্পানির কারিগরদের অর্থসাহায্য দিলেন, তাদের খাওয়া-পরার ভার নিলেন। ফলে তুঙ্গে উঠল তার জনপ্রিয়তা।
১৯৩২ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন টমাস। এরপর কোম্পানির হাল ধরলেন টমাসের ভাই অ্যান্টোনিন। প্রতিষ্ঠানটিতে তখন ১৬ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করে। বিশটিরও বেশি শাখা বিস্তৃত হয়েছে বোহেমিয়া, মোরাভিয়া, সেøাভাকিয়ায়। এবার অ্যান্টোনিনের হাত ধরে বাটা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ায়। ব্রাজিল, ব্রিটেন, কানাডায় জমে উঠল বাটার পসার।
ভারতবর্ষে বাটা পা রাখে ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে। হুগলির কোন্নগরে এক বিঘামতো জমি নিয়ে গড়ে তোলা হতে লাগল কারখানা। কিন্তু সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কলকাতা থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে মীরপুর নামক এলাকায় কারখানা সরিয়ে আনা হলো। সে সময় ওই এলাকায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে গেছিল। তাই পরিবহন ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বাটার পসার জমতে সময় লাগেনি। কথিত আছে, মীরপুরের নাম বদলে পরে বাটানগর রাখা হয়।
বাটা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম জুতা উৎপাদনকারী ও বিপণনকারী। তাদের এই সাফল্য এসেছে বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনা ও প্রতিযোগিতামূলক দাম রাখার কারণে। বাটা শ্যু অর্গানাইজেশন এখন চারটি ব্যবসা ইউনিটের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে—বাটা ইন্টারন্যাশনাল, বাটা ইউরোপ, বাটা ল্যাটিন আমেরিকা ও বাটা কানাডা।

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন দশ লাখ বাটা জুতা বিক্রি হয়। তাদের কর্মীসংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি, বিক্রয়কেন্দ্র ৫ হাজারের বেশি। ৭০টির বেশি দেশে তাদের জুতা বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। আর জুতা উৎপাদন কারখানা আছে ২০টির বেশি দেশে।
বিপণন
অভিনব ও চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনকৌশলের সুবাদে অচিরেই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বাটার। তাদের বিজ্ঞাপনের কৌশল ধার নিয়েছে অনেক কোম্পানি।
শুরু থেকেই বাটা হরেক রকমের জুতা বিক্রি কওে আসছে। মানুষের প্রয়োজন অনুসারে শ্যু, চটি, কেডসসহ প্রায় সব ধরনের জুতাই বিক্রি করছে কোম্পানিটি। বাটার জুতা সবচেয়ে জনপ্রিয় টেকসই হওয়ার কারণে। আজও সহনীয় দামে সবচেয়ে টেকসই জুতা বিক্রি করা কোম্পানিগুলোর একটি বাটা।
বাংলাদেশের সীমিত আয়ের মানুষের কাছে এ কারণেই বাটার সহনীয় দামের টেকসই জুতা এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দাম কম রাখার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাটার স্থানীয় উৎপাদন ইউনিট।
দাম
বাটা বিপণনকৌশলের যে বিষয়টিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়, সেটি হলো দাম নির্ধারণ। জুতার মূল্য নির্ধারণে বাটা মনস্তাত্ত্বিক কৌশল খাটায়। খেয়াল করলে দেখবেন, বাটার অধিকাংশ জুতার দাম শেষ হয় ৯ দিয়ে। যেমন, ৪৯৯, ৯৯৯, ১০৯৯ টাকা। দারুণ কাজে দিচ্ছে এই কৌশল।
তবে বাটা তাদের জুতার দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই রাখে। এমনকি এই সময়ে এসেও বাটার চপ্পলের দাম ১০০ টাকার কম।

বিপণন নেটওয়ার্ক
তবে বিপণনকৌশলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিপণন নেটওয়ার্ক। বিস্তৃত বিপণন চ্যানেল না থাকলে কোনো পণ্যের দামই কম রাখা সম্ভব হয় না। সহজে বিপণনের জন্য পণ্য স্থানীয়ভাবেও উৎপাদন করতে হয়। আমদানি শুল্ক ও কর কমানোর জন্যও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন জরুরি। এছাড়া দেশজুড়ে বাটার বিপুলসংখ্য ডিলার পয়েন্ট ও বিক্রয়কেন্দ্র আছে। ফলে মানুষ সহজেই বাটা জুতা কিনতে পারে।
গ্রামীণ বিপণন চ্যানেল বাটার বড় শক্তি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও বাটার শোরুম ও ডিলারশিপ আছে। এতে ব্র্যান্ডটির পসার আরও বেড়েছে।
বাটার দেওয়া তথ্যানুসারে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের ২৬২টি খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও দেশজুড়ে কোম্পানিটির পাইকারি ডিপো আছে ১৩টি। এসব ডিপোর আওতায় ৪৭১টি রেজিস্টার্ড পাইকারি ডিলার ও ৬৯০টি ডিলার সাপোর্ট প্রোগ্রাম সাপোর্ট স্টোর কার্যক্রম চালাচ্ছে।
প্রচারণা
বাটা কখনোই গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের জোয়ার বইয়ে দেয়নি। কোম্পানিটি ক্রেতা টানার জন্য ব্র্যান্ডের গুণমান বজায় রাখায় বিশ্বাসী। এছাড়াও টেকসই পণ্য উৎপাদনের সুনামও বাটার প্রসারে সাহায্য করেছে।
মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিলেও বাটা বেশিরভাগ সময়ই এসব বিজ্ঞাপন দিয়েছে শুধু নতুন পণ্য বা মূল্যছাড়ের খবর জানতে। প্রচারণামূলক কাজে কম খরচ কারণে বাটা তাদের পণ্যের দামও তুলনামূলক কম রাখতে পারে।
তবে অন্যান্য দামি ব্র্যান্ড ও সস্তা চীনা জুতার উত্থানে বাটার ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়েছে।
বাংলাদেশ থেকে বাটার হারিয়ে যাওয়া ব্র্যান্ডগুলো
যেকোনো কোম্পানির জন্যই ব্র্যান্ড জিনিসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্র্যান্ডই ভোক্তাদের রুচির পরিচয় বহন করে। বাটাও তাদের অধীনে অনেক ব্র্যান্ড তৈরি করেছিল। কিন্তু একসময় জনপ্রিয়তা পেলেও ওসব ব্র্যান্ড এখন আর বাংলাদেশে নেই। কিংস্ট্রিট, হাওয়াইয়ানস, সান্ডাক—বাটার এই ব্র্যান্ডগুলো আমাদের দেশ থেকে উঠে গেছে। আটের দশকে নারীদের মধ্যে সান্ডাক দারুণ জনপ্রিয় ছিল।
এসব ব্র্যান্ড উঠে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভোক্তাদের রুচি বদলে যাওয়া এবং তাদের দামি পণ্য কেনার সামর্থ্য বৃদ্ধি পাওয়া।
বিদেশি বাটার দেশি হয়ে ওঠা
আন্তর্জাতিক কোম্পানি হলেও বাটা বাংলাদেশে আছে প্রায় ৬০ বছর ধরে। ফলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি দেশি প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) বাটা আসে ১৯৬০ সালে। বাংলার মানুষ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অত্যাচার, বৈষম্যে তিতিবিরক্ত। পূর্ব পাকিস্তানে পণ্য উৎপাদন ও আয় হয়, কিন্তু সেই টাকা চলে যায় পশ্চিমে।
পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালির দু-পয়সা দাম না থাকলেও, এ অঞ্চলে ব্যবসার সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পায় বাটা। ১৯৬২ সালে তারা পূর্ব পাকিস্তানে কারখানা স্থাপন করে। সেই থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে এই বহুজাতিক কোম্পানি। বাংলাদেশে বাটার এখন দুটি কারখানা রয়েছে—একটি টঙ্গীতে, অন্যটি ধামরাইয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে বাটা
১৯৭০ সালে বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পূর্ব বাংলায় আসেন উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড। হল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলীয় নাগরিক ওডারল্যান্ড ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী। পূর্ব বাংলার অসহায়, সহজ-সরল মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অমানুষিক শোষণ-অত্যাচার দেখে অন্তর কেঁদে ওঠে এই মহান যদ্ধার। তাই একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যার উৎসব শুরু হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ওডারল্যান্ড, অস্ত্র হাতে নেমে পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে।
ওডারল্যান্ডের নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা এবং আশপাশের এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন হয়। টঙ্গীর বাটা কারখানায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন ওডারল্যান্ড, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অস্ত্র, তথ্য, ওষুধ সরবরাহ করেছেন।
নয় মাস সংগ্রামের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামা ওডারল্যান্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ পায় বাংলার মানুষ। তাই বিদেশি এই বন্ধুকে বাংলাদেশ সরকার ভূষিত করে বীর প্রতীক খেতাবে। এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হওয়া একমাত্র বিদেশি তিনি। এভাবেই পোড়খাওয়া মানবদরদি যোদ্ধা ওডারল্যান্ডের হাত ধরে বাটা মিশে গেছে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে।