বিশ্ব মাতানো 'স্নিকার ডিজাইনার' সালেহি বেম্বুরি আসছেন নিজের জুতার ব্র্যান্ড নিয়ে
মনে মনে নিজের ক্যারিয়ারের একটা প্রদর্শনী বা মিউজিয়ামের ছবি আঁকছেন সালেহি বেম্বুরি। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এই জুতা ডিজাইনারের ঝুলিতে দেখানোর মতো কাজের অভাব নেই। ভারসাচির মতো অভিজাত ফ্যাশন হাউজকে স্নিকারের বাজারে নামানোর কৃতিত্ব তারই। র্যাম্পের ঝকঝকে দুনিয়া থেকে ফুটপাতের সাধারণ দোকান—সবখানেই তার জাদুকরী ডিজাইন। ইজি, নিউ ব্যালেন্স, ক্রোকস, পুমা কিংবা মঙ্কক্লেয়ার—কোথায় নেই তার হাতের ছোঁয়া!
তবে নিজের কল্পনার সেই প্রদর্শনীতে তিনি একটা 'নিষিদ্ধ ঘর' বা 'গোপন কক্ষ' রাখতে চান। যেখানে থাকবে এমন সব জুতা, যা তিনি ডিজাইন করেছেন ঠিকই, কিন্তু কেউ জানে না।
ব্যাপারটা অবাক করার মতো হলেও সত্যি। বেম্বুরি অনেক বড় বড় ব্র্যান্ডের জন্য আড়ালে থেকে কাজ করেছেন, যাকে ফ্যাশন দুনিয়ায় বলা হয় 'গোস্ট ডিজাইনিং'। কিন্তু কড়া চুক্তির কারণে তিনি মুখ ফুটে বলতে পারেন না—আসলে কাজটা তার। হয়তো কোনো একদিন বলতে পারবেন, কিন্তু আজ সেই দিন নয়।
৩৯ বছর বয়সী এই ডিজাইনার অবশ্য নিজেই হেসে ফেললেন। কারণ, তার নতুন বইতে তিনি ভুল করে এই গোপনীয়তার কথাটা ফাঁস করে দিয়েছেন!
বইটির নাম 'সালেহি: আই মেক শুজ' । এটি শুধু বই নয়, তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের দলিল। সাক্ষাৎকার, ছবি আর অলঙ্করণ দিয়ে সাজানো এই বইতে স্নিকার জগতের অলিগলির গল্প বলা হয়েছে। বেম্বুরি বলেন, 'স্নিকার আর এর উন্মাদনা বা 'হাইপ কালচার' নিয়ে খুব একটা বই নেই। তরুণ ডিজাইনার, যারা নিজেদের পথ খুঁজছে বা ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে—তাদের জন্য আমার এই বই একটা গাইড হতে পারে।'
স্নিকার এখন হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এখানে ডিজাইনাররা খুব একটা পরিচিতি পান না; ব্র্যান্ডের নামটাই বড় হয়ে থাকে। নাইকির কিংবদন্তি টিঙ্কার হ্যাটফিল্ডের মতো খুব অল্প কয়েকজনই তারকখ্যাতি পেয়েছেন। বেম্বুরি এখন সেই পথেই হাঁটছেন।
নিউ ইয়র্কের অলিগলি থেকে উঠে আসা
বেম্বুরি এই স্নিকার সংস্কৃতিরই সন্তান। নব্বইয়ের দশকে নিউ ইয়র্কে বড় হওয়ার সময় বাস্কেটবল খেলা বা টিভিতে 'ফ্রেশ প্রিন্স অফ বেল এয়ার' দেখার চেয়ে তার চোখ বেশি আটকে থাকত মানুষের পায়ের জুতায়। তার বাড়ির কাছেই ক্যানাল স্ট্রিটে নকল জুতার রমরমা ব্যবসা ছিল। কিন্তু তিনি নকল বা 'কপি' জিনিস ঘৃণা করতেন। তার পছন্দ ছিল নাইকির জর্ডান ১১ বা এয়ার ফুটস্কেপের মতো 'আসল' সব জুতা। তবে তিনি শুধু নাইকিতেই আটকে ছিলেন না, অন্য যেকোনো ভালো ডিজাইন তাকে টানতো।
ছোটবেলা থেকেই তার লক্ষ্য ছিল স্থির—স্নিকার ডিজাইনার হবেন। বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে নিরাপদ কোনো পেশায় যাক। তাই তিনি সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন নিয়ে পড়েন। পরে তিনি বুঝেছিলেন, এই পড়ালেখাটাই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় শক্তি। তিনি বলেন, 'জুতা ডিজাইন আসলে মিলিমিটারের খেলা আর যোগাযোগের দক্ষতা।'
তার দর্শন হলো—জিনিসটা দেখতে সুন্দর হতে হবে, আবার কাজেও লাগতে হবে। তার ভাষায়, 'যদি সেটা ঠিকমতো কাজ না করে, তবে সেটা শুধুই শিল্পকর্ম, জুতা নয়।'
২০১১ সালে কোল হান কোম্পানিতে তার প্রথম ব্রেক আসে। তখন কোম্পানিটি নাইকির মালিকানাধীন ছিল। সেখানে তিনি জুতা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পান। এরপর 'গ্রেটস' নামের স্টার্টআপে যোগ দিয়ে নিজের অনুসারী বা ভক্ত তৈরি করতে থাকেন। ২০১৫ সালে র্যাপার কানি ওয়েস্টের (বর্তমানে ইয়ে) ডাক পান তিনি।
ইজি ও ভারসাচি অধ্যায়
কানি ওয়েস্টের দলে যোগ দিতে তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে যান। সেখানে ইজি-র (Yeezy) জন্য মিলিটারি স্টাইলের বুট তৈরি করেন। কানি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমার কাজ ছিল তার 'পেন্সিল' হওয়া। অর্থাৎ, তার মাথার আইডিয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। তার সঙ্গে কাজ করে আমি হাই ফ্যাশন জগতের সম্মান পেয়েছি। ওটা ছিল আমার জন্য একটা দরজা খোলার মতো।'
কিন্তু ২০১৬ সালে ইজি ছাড়ার পর তিনি বেশ বিপদে পড়েন। হাতে কাজ নেই, টাকাও ফুরিয়ে আসছে। মরিয়া হয়ে তিনি লিংকডইনে বড় বড় কর্তাদের মেসেজ দিতে শুরু করেন। তাদের একজন ছিলেন ভারসাচি-র তৎকালীন ডিজাইন ডিরেক্টর।
বেম্বুরি সেই দিনের কথা মনে করে বলেন, 'লোকে শুনলে হাসবে, কিন্তু সত্যিটা হলো—আমি তখন টয়লেটে বসে ওই মেসেজটা পাঠিয়েছিলাম!' তিনি ভারসাচিকে বুঝিয়েছিলেন, স্নিকারের বাজারে না আসাটা তাদের ভুল হচ্ছে। তিন দিন পর ডোনাতেলা ভারসাচি তাকে মিলানে ডাকেন। ২০১৭ সালে তিনি সেখানে স্নিকার ডিজাইনের প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
ভারসাচি-তে তার ডিজাইন করা 'চেইন রিঅ্যাকশন' স্নিকার তোলপাড় ফেলে দেয়। জুতার তলা বা সোল ছিল মোটা সোনার চেইনের মতো—যা ভারসাচি ব্র্যান্ডের আভিজাত্যের সঙ্গে মিলে যায়।
ক্রোকস বিপ্লব
ভারসাচি-র চাকরিতে থেকেও তিনি অন্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। নিউ ব্যালেন্সের জুতায় তিনি হিলের পেছনে একটা বাঁশি জুড়ে দিয়েছিলেন। কেন? স্টিভ জবসের সেই বিখ্যাত উক্তি মেনে তিনি বলেন, 'মানুষ আসলে জানে না তারা কী চায়, যতক্ষণ না আপনি তাদের সেটা দেখাচ্ছেন।'
২০২০ সালে ভারসাচি ছেড়ে তিনি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন। এরপরই আসে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চমক—ক্রোকস।
২০২১ সালে তিনি ক্রোকসের জন্য 'পলেক্স ক্লগ' ডিজাইন করেন। এটি ছিল তার নিজের আঙুলের ছাপের আদলে তৈরি এক অদ্ভুত ডিজাইন। এটি বাজারে আসতেই ছোট-বড় সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। বেম্বুরি বলেন, 'ক্রোকস আমার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আগে আমি শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্টাইলিশ মানুষের জন্য কাজ করতাম, কিন্তু এই জুতাটা সাধারণ মানুষও লুফে নিল।'
স্বপ্ন এখন নিজের ব্র্যান্ড 'স্পাঞ্জ'
তার জাদুকরী ডিজাইনের জন্য ক্লার্কস, ভ্যানস, কানাডা গুসের মতো কোম্পানিগুলো তাকে দলে ভেড়াতে লাইন দেয়। এমনকি তার ছোটবেলার স্বপ্নের কোম্পানি নাইকিও তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু শর্ত পছন্দ না হওয়ায় তিনি মুখের ওপর না করে দেন। এ নিয়ে অবশ্য তিনি বেশি কথা বলতে চান না।
অন্য ডিজাইনাররা এখন তার কাজ নকল করে নিজেদের 'মুড বোর্ডে' টাঙিয়ে রাখেন। এটা তার প্রভাবেরই প্রমাণ।
সবশেষে, নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গত অক্টোবরে বেম্বুরি নিজের স্নিকার ব্র্যান্ড 'স্পাঞ্জ' চালু করেছেন। তিনি বলেন, 'অনেক দেরি হয়ে গেছে। জুতা শিল্পে খুব কম মানুষই আমার মতো নিজস্ব ভক্তকুল তৈরি করতে পেরেছে। এখন সময় এসেছে নিজের ব্র্যান্ডের মাধ্যমে নিজের সবটুকু ঢেলে দেওয়ার।'
স্পাঞ্জ-এর প্রথম মডেল 'অসমোসিস' ১৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এটি দেখতে যেমন স্টাইলিশ, তেমনি পাহাড়ে চড়ার জন্যও জুতসই। বেম্বুরি নিজেও ঘুরতে পছন্দ করেন, তাই তার জুতায় সেই ছাপ স্পষ্ট।
একসময়ের কানি ওয়েস্টের 'পেন্সিল' এখন নিজের দলের বস। তিনি বলেন, 'শুরুতে অন্যদের দিয়ে কাজ করানোটা অস্বস্তিকর লাগত। কিন্তু নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে হলে নিজের দল থাকাটা জরুরি।'
