জুতার গড়ন পায়ের মাপমতো না হলে শরীরের যে ক্ষতি হয়

বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়া, বাজার করা বা টুকিটাকি কাজে যাওয়ার সময় আমরা পায়ের জুতা নিয়ে খুব একটা ভাবি না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন এই সাধারণ জুতাই আপনার স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পায়ের গড়নের সাথে অমানানসই জুতা শুধু পায়ের পাতায় কড়া পড়া, নখের সমস্যা বা ব্যথাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এর প্রভাব পড়ে কোমর থেকে শুরু করে পুরো শরীরেই।
পায়ের পাতার বিশেষজ্ঞ মিগুয়েল কুনহা বলেন, "আমাদের পা হলো শরীরের ভিত্তি। ভুল মাপের জুতা পরলে তা পুরো শরীরেই খারাপ প্রভাব ফেলে। ক্লান্তি থেকে শুরু করে শরীরের গঠনে ভারসাম্যহীনতাও তৈরি হতে পারে।" এই সব ব্যথার পেছনের কারণগুলো বুঝতে পারলেই পা ছাড়িয়ে শরীরের অন্যান্য অংশের যন্ত্রণা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ভুল জুতা কীভাবে ব্যথার কারণ হয়?
সঠিকভাবে এবং ব্যথা ছাড়া হাঁটতে হলে আমাদের এমন জুতা দরকার যা পায়ের স্বাভাবিক গড়ন ও গতিকে সমর্থন করে। শারীরিক থেরাপিস্ট অটো ল্যাম বলেন, "আমরা যখনই হাঁটি, আমাদের পায়ের পাতার আকৃতি বদলানোর প্রয়োজন হয়।" নিয়ম হলো, প্রথমে গোড়ালি মাটিতে পড়ে, তারপর পুরো পাতা সামনে গড়িয়ে যায় এবং শেষে আঙুলগুলো ছড়িয়ে গিয়ে শরীরকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ভুল জুতা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়।
ল্যাম বলেন, "যদি চওড়া পায়ের কোনো ব্যক্তি একটি সরু জুতা পরেন, তাহলে তার পায়ের পাতা মাটির সঙ্গে পুরোপুরি মিশতে পারে না।" এই বাধার কারণে হাঁটার গতি কমে যায় এবং শরীরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোমর ও পিঠের নিচের অংশে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ধীরে ধীরে এই ছোট ছোট সমস্যাগুলোই দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, হাঁটার ভঙ্গি নষ্ট করে এবং শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
কিছু নির্দিষ্ট ধরনের জুতা আবার সমস্যা তৈরি করে। যেমন, ফ্লিপ-ফ্লপ বা খোলা চপ্পল পরলে জুতাকে পায়ে আটকে রাখার জন্য আমাদের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরতে হয়। এই আঁকড়ে ধরার কারণে আঙুলগুলো স্বাভাবিকভাবে ছড়াতে পারে না, যা হাঁটার জন্য জরুরি। এর ফলে শুধু পায়ের তলাতেই চাপ সৃষ্টি হয় না, কাফ পেশিতেও ব্যথা হতে পারে। একইভাবে, যে জুতাতে আর্চ সাপোর্ট (পায়ের তলার বাঁকানো অংশে সাপোর্ট) কম থাকে বা যা পুরোপুরি সমতল তা হাঁটুর ভেতরের দিকে ব্যথার কারণ হতে পারে। হাই হিল পরলে শরীরের ওজন সামনের দিকে ঝুঁকে যায়, যা পায়ের পাতা এবং কোমরের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। আবার স্লিপ-অন, মিনিমালিস্ট বা প্ল্যাটফর্ম জুতা শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যার ফলে মাংসপেশিকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
এমনকি যদি এক পায়ের জুতাও অস্বস্তিকর হয়, তাহলেও সমস্যা হতে পারে। ল্যাম বলেন, "ধরুন কোনো কারণে আমার ডান পায়ের জুতাটা অস্বস্তিকর লাগছে, কিন্তু বাঁয়েরটা নয়। তখন আমি অজান্তেই ডান পায়ে কম ভর দেব এবং অন্য পায়ের ওপর বেশি চাপ দেব, যা অন্য পাশের হাঁটু, কোমর এবং পিঠের ওপর চাপ বাড়াবে।" সুতরাং, জুতার ভুল মাপ, পুরনো কুশন বা পায়ের গঠনের সঙ্গে জুতার ডিজাইনের অমিল এই সবই নীরবে শরীরে ব্যথার একটি চক্র তৈরি করতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন শরীরের ব্যথা জুতা সম্পর্কিত?
বিশেষজ্ঞ কুনহা তার রোগীদের প্রথমে যা করতে বলেন, তা হলো তাদের জুতা খুলে পরীক্ষার টেবিলে রাখতে, কারণ জুতার তলার ক্ষয়ের ধরনই অনেক কথা বলে দেয়। তিনি বলেন, "হাঁটার সময় আমাদের পায়ের আর্চ বা বাঁকান অংশ কিছুটা দেবে যায়, একেই প্রোনেশন বলে। কিন্তু যদি আপনার পা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভেতরের দিকে বেঁকে যায়, তাহলে জুতার ভেতরের দিকে এবং গোড়ালির অংশে বেশি ক্ষয় হবে।" এর ফলে আপনার পা ভেতরের দিকে বেঁকে যায় এবং তার সাথে সাথে আপনার পা-ও ঘুরে যায়, যা থেকে পায়ের পাতায় প্ল্যান্টার ফ্যাসাইটিস, গোড়ালিতে অ্যাকিলিস টেন্ডিনাইটিস, হাঁটুর ভেতরে ব্যথা, এবং কোমর ও পিঠের নিচের অংশে ব্যথা হতে পারে।
কারণটি সঠিকভাবে জানার জন্য কুনহা প্রায়শই "গেইট অ্যানালিসিস" বা হাঁটার ভঙ্গি পরীক্ষা করেন। কখনও এটি ক্লিনিকে করা হয়, আবার কখনও রোগীর হাঁটার একটি সাধারণ ভিডিও দেখেই হাঁটার ভঙ্গিতে অস্বাভাবিকতা ধরা যায়। এই সূত্রগুলোই বলে দেয় যে ব্যথাটি শরীরের গঠনগত সমস্যার কারণে হচ্ছে, নাকি ভুল জুতার জন্য।
সঠিক জুতা কীভাবে খুঁজবেন
একবার ব্যথার কারণ জানা গেলে, এমন জুতা খোঁজার দিকে মনোযোগ দিন যা আপনার পায়ের আকৃতি এবং হাঁটার ধরনের সঙ্গে মেলে। চ্যাপ্টা পায়ের জন্য মজবুত মিডসোলযুক্ত স্টেবিলিটি জুতা উপকারী হতে পারে, আর উঁচু আর্চের জন্য অতিরিক্ত কুশনযুক্ত জুতা প্রয়োজন হয়। চওড়া পায়ের জন্য এমন জুতা দরকার যেখানে আঙুলগুলো ছড়ানোর যথেষ্ট জায়গা থাকে, আর সরু পায়ের জন্য একটু আঁটসাঁট ফিটিং প্রয়োজন যাতে পা পিছলে না যায়।
কুনহা এবং ল্যাম দুজনেই দোকানে গিয়ে নিজে পরে দেখে জুতা কেনার পরামর্শ দেন। সেখানে আপনি কেবল জুতার ফিট পরীক্ষা করতে পারবেন না, বরং একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্যে ব্র্যানক ডিভাইসের মাধ্যমে পায়ের সঠিক মাপও (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং আর্চের দৈর্ঘ্য) নিতে পারবেন।
কুনহা বলেন, "আমি রোগীদের সবসময় দিনের শেষে জুতা কিনতে বলি, কারণ তখন সারাদিনের হাঁটাচলার ফলে পা কিছুটা ফোলা থাকে।" সঠিক মাপের একটি জুতা পরার সাথে সাথেই আপনি শরীরে স্বস্তি অনুভব করবেন। তিনি যোগ করেন, "আপনি এটি আপনার পিঠেও অনুভব করতে পারবেন। নিজেকে হালকা লাগবে। এমনকি দোকানে হাঁটার সময়েও দেখবেন আপনার কোমরের ব্যথা কিছুটা কমে গেছে।"
স্থায়িত্ব এবং শারীরিক সমর্থনের জন্য, কুনহা আমেরিকান বোর্ড অফ পোডিয়াট্রিক মেডিসিন দ্বারা অনুমোদিত ব্র্যান্ডের জুতা বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।"আমি যে ব্র্যান্ডগুলোর জুতা সুপারিশ করি সেগুলো হলো হোকা (Hoka), ব্রুকস (Brooks), সকোনি (Saucony), নিউ ব্যালেন্স (New Balance), এবং এসিক্স (ASICS)," তিনি বলেন। "এরা ফ্যাশনের চেয়ে আরামকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।"
এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সেরা জুতারও একটি নির্দিষ্ট আয়ু থাকে। হাঁটা বা দৌড়ানোর জুতা সাধারণত ৩০০-৫০০ মাইল বা প্রায় ৬-১২ মাস নিয়মিত ব্যবহারের পর কার্যকারিতা হারায়। সাধারণ স্নিকার্স হয়তো আরও বেশি দিন টেকে, কিন্তু যখনই জুতার তলা ক্ষয়ে যায়, মিডসোল বসে যায় বা নতুন করে ব্যথা শুরু হয়, তখনই জুতা বদলানো উচিত।
শেষ কথা হলো, সঠিক জুতা সেটাই যা আপনার দুই পায়েই আরাম দেয় এবং আপনার স্বাভাবিক হাঁটার ভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করে। কুনহা বলেন, "আমাদের শরীর এর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনাকে পুরো শরীরের যত্ন নিতে হবে এবং এর প্রতিটি অংশের দিকে আলাদাভাবে মনোযোগ দিতে হবে।"