পায়ের জুতোটাও এবার পরিষ্কার করুন! বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন সহজ উপায়
জামা, প্যান্ট, জ্যাকেট—বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসা প্রায় সবকিছুই নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সম্ভবত জুতো জোড়া কখনোই পরিষ্কার করা হয় না।
টেক্সাসের একজন পোডিয়াট্রিস্ট বা পায়ের রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান শার্কির মতে, এই অভ্যাসটা এখনই বদলানো দরকার। তার চোখে, জুতো হলো এক-একটি চলন্ত জীবাণুর কারখানা। তিনি বলেন, 'ভাবুন তো, কোনো স্কুলের বাথরুম দিয়ে হেঁটে যাওয়া হচ্ছে, কিংবা কোনো নোংরা পার্কিং লটে ঘোরা হচ্ছে,' অথবা অজান্তেই কুকুরের মল বা পাখির বিষ্ঠার ওপর পা পড়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, 'বাইরে যদি প্রচুর অ্যালার্জেন থাকে, সেগুলোও জুতোর গায়ে লেগে যায়, সঙ্গে থাকে আরও কত রকমের ময়লা।'
গবেষণায় দেখা গেছে, একজোড়া জুতোর বাইরের অংশে প্রায় ৪ লক্ষ ২১ হাজার জীবাণু থাকতে পারে, আর ভেতরের অংশে থাকে প্রায় ৩ হাজার। সুখবর হলো, জুতো নিয়ম মেনে পরিষ্কার করলে এই জীবাণুর ৯০-৯৯ শতাংশই দূর করা সম্ভব। চলুন, জেনে নেওয়া যাক কতদিন পর পর জুতো পরিষ্কার করা উচিত এবং কীভাবে করলে জুতো নষ্ট হবে না।
জুতোর গায়ে কী ধরনের জীবাণু লুকিয়ে থাকে?
কোথায় পা পড়ছে, তার ওপর নির্ভর করে জুতোর গায়ে ইকোলাই, সালমোনেলা, এমআরএসএ-এর মতো মারাত্মক জীবাণু থাকতে পারে, যা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ থেকে শুরু করে ত্বকের নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। জীবাণু বিশেষজ্ঞ ক্যারেন ডুস বলছেন, 'মানুষ টয়লেট সিটকে খুব নোংরা মনে করে, কিন্তু সত্যিটা হলো, জুতো তার চেয়েও বেশি নোংরা।' তাঁর যুক্তিটা খুব সহজ, 'টয়লেট সিট তো শুধু মানুষের পশ্চাদ্দেশই দেখে। কিন্তু একজোড়া জুতো যে কী কী দেখে, তার কি কোনো ঠিক আছে?'
দরজার পাপোশে জুতো ঘষে নেওয়াতেও খুব একটা লাভ হয় না, কারণ জুতোর সোলের খাঁজে খাঁজে জীবাণুরা দিব্যি লুকিয়ে থাকে। কিছু জীবাণু কয়েক ঘণ্টা বা সপ্তাহ বাঁচে, কিন্তু কিছু ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাল স্পোর, কৃমির ডিম বা পরজীবী মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও বেঁচে থাকতে পারে।
কতদিন পর পর জুতো পরিষ্কার করা উচিত?
জুতো কতটা নোংরা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এটি পরিষ্কার করা উচিত। সাধারণভাবে, শার্কি প্রতি দুই মাস অন্তর একবার ভালো করে জুতো ধোয়ার পরামর্শ দেন। তবে খেলাধুলার জন্য প্রতিদিন ব্যবহৃত জুতো, যাতে খুব ঘাম হয়, তা প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর মেশিনে পরিষ্কার করে নেয়া ভালো।
এর পাশাপাশি, রাবার বা প্লাস্টিকের জুতো নিয়মিত ব্লিচ ওয়াইপ (জীবাণুনাশক ভেজা টিস্যু) দিয়ে মুছে নেওয়া যেতে পারে। তবে চামড়া বা সোয়েডের জুতোর ওপর এটি ব্যবহার করা যাবে না। শার্কি বলেন, 'ঘরেও যদি বাইরের জুতো পরা হয়, তাহলে প্রতিদিন মুছে রাখাই ভালো। কারণ ঘরে ছোট বাচ্চা থাকলে, সে হামাগুড়ি দেওয়ার সময় জুতোর তলার ময়লা তার হাতে লেগে যেতে পারে।'
মেশিনে জুতো কাচার নিয়ম
কিছু জুতো, যেমন—ফ্লিপ-ফ্লপ, স্যান্ডেল, ক্যানভাস, কটন বা নাইলনের তৈরি জুতো ওয়াশিং মেশিনে কাচার জন্য যথেষ্ট মজবুত। তবে মনে রাখতে হবে, ঠান্ডা জল এবং হালকা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক ইউটিউব চ্যানেল 'ক্লিন মাই স্পেস'-এর সঞ্চালক মেলিসা মেকারের পরামর্শ, 'জুতো কাচার আগে তার লেবেল বা ওয়েবসাইটে দেখে নিন মেশিনে কাচা যাবে কি না।' আজকাল অনেক ব্র্যান্ডই মেশিন-ওয়াশেবল জুতো তৈরি করছে।
মেশিনে জুতো কাচার জন্য একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। জুতো খুব বেশি নোংরা হলে, কাচার আগে একটি পুরোনো টুথব্রাশে ডিশ সোপ লাগিয়ে ভালো করে ঘষে নেওয়া প্রয়োজন। এরপর মেশিনে দেওয়ার সময় সঙ্গে কয়েকটি পুরোনো তোয়ালে দিয়ে দিলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এতে জুতোর সোল ভালোভাবে পরিষ্কার হয় এবং মেশিনের ভেতরে জুতো জোড়ার ধাক্কাধাক্কির শব্দও অনেক কমে আসে। কাচা হয়ে গেলে জুতো কখনোই ড্রায়ারে শুকানো উচিত নয়, কারণ অতিরিক্ত তাপ জুতোর আঠা গলিয়ে দিতে পারে বা এর আকার নষ্ট করে ফেলতে পারে। বরং, বাতাসে শুকোতে দেওয়াই সবচেয়ে ভালো উপায়। শুকোনোর সময় জুতোর আকার ঠিক রাখতে ভেতরে খবরের কাগজ মুড়িয়ে ঢুকিয়ে রাখা যেতে পারে।
চামড়া বা সোয়েডের মতো দামী জুতো পরিষ্কার করার উপায়
যেসব জুতো, যেমন—হিল, চামড়া বা সোয়েডের তৈরি, সেগুলো মেশিনে দিলে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। তবে সেগুলোও পরিষ্কার রাখার বিশেষ উপায় আছে। প্রথমে একটি নরম ব্রাশ দিয়ে জুতোর ওপরের আলগা ময়লা ভালোভাবে ঝেড়ে ফেলতে হবে। ময়লা ঝাড়া হয়ে গেলে, ব্রাশে কিছুটা শু ক্লিনিং সলিউশন বা জুতো পরিষ্কার করার তরল নিয়ে বৃত্তাকারে আলতো করে ঘষতে হবে। এরপর একটি পরিষ্কার ও ভেজা মাইক্রোফাইবারের কাপড় দিয়ে জুতোর ওপর লেগে থাকা অতিরিক্ত তরল সাবধানে মুছে ফেলতে হবে। সবশেষে, ইচ্ছে হলে শু কন্ডিশনার স্প্রে করা যেতে পারে। এটি অনেকটা নেলপলিশের ওপর টপকোট দেওয়ার মতো কাজ করে, যা জুতোকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয় এবং সহজে ময়লা বসতে বাধা দেয়।
ফিতে পরিষ্কার করবেন কীভাবে?
জুতোর ফিতে যদি ময়লা হয়ে তার আসল রঙটাই হারিয়ে ফেলে, তবে সেটিও পরিষ্কার করা দরকার। এর জন্য প্রথমে জুতো থেকে ফিতেগুলো খুলে ফেলতে হবে এবং দাগ তোলার জন্য স্টেইন রিমুভার অথবা বেকিং সোডা ও জলের মিশ্রণ দিয়ে ভালোভাবে ঘষে নিতে হবে। এরপর ফিতেগুলোকে একটি লন্ড্রি ব্যাগে (ছোট জালির ব্যাগ) ভরে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিলে অন্য কাপড়ের সঙ্গে জট পেকে যাওয়ার ভয় থাকে না। গরম জলে কাচার পর ফিতেগুলো ঝুলিয়ে বাতাসে শুকিয়ে নিলেই চলবে। পরিষ্কার ফিতে পুরোনো জুতোতেও একটা নতুন ও ঝকঝকে ভাব এনে দেয়।
দুর্গন্ধ দূর করার কৌশল
জুতো দেখতে পরিষ্কার হলেও অনেক সময় দুর্গন্ধ হতে পারে। এই সমস্যা দূর করার বেশ কিছু সহজ সমাধান আছে। একটি অত্যন্ত কার্যকর উপায় হলো, জুতোর ইনসোল বা ভেতরের নরম অংশটি বের করে কয়েক ঘণ্টা কড়া রোদে রাখা। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে সহজেই মেরে ফেলে। আরেকটি ভালো উপায় হলো অ্যাক্টিভেটেড চারকোলের ছোট ছোট প্যাকেট জুতোর ভেতরে রেখে দেওয়া, কারণ এটি গন্ধ শুষে নিতে দারুণ কাজ করে। এছাড়া, ঘরেই দুর্গন্ধনাশক পাউডার বানিয়ে নেওয়া যায়। আধা কাপ কর্নস্টার্চ, এক-চতুর্থাংশ কাপ বেকিং সোডা এবং এক-চতুর্থাংশ কাপ বেকিং পাউডার একসঙ্গে মিশিয়ে নিলেই এটি তৈরি হয়ে যাবে। এই পাউডার সামান্য পরিমাণে জুতোর ভেতরে ছিটিয়ে সারারাত রেখে দিয়ে পরদিন ব্যবহারের আগে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
এর পাশাপাশি, পায়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো সর্বদা মোজা পরা। মোজা পায়ের ঘাম শুষে নেয়, ফলে পা শুকনো থাকে এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জন্মাতে পারে না।
হাত পরিষ্কার রাখা
জুতো পরিষ্কার রাখা যেমন জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি হলো হাত পরিষ্কার রাখা। ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রিচার্ড মার্টিনেলো বলেন, জুতোর জীবাণু সাধারণত সরাসরি অসুস্থ করে না। কিন্তু বিপদ তখনই হয়, যখন সেই জীবাণুমাখা জুতো হাত দিয়ে খোলা বা পরা হয়, আর তারপর সেই হাত মুখে যায় বা খাবার তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জুতোর সংস্পর্শে আসার পর অবশ্যই ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলা।
