অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফেরত চায় নির্বাচন কমিশন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটে অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ফিরে পেতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত অষ্টম কমিশন সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় ইসি সানাউল্লাহ বলেন, 'কোন নির্দিষ্ট আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য আমরা আবেদন করেছি। পুরো আসনের নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা আমাদের আগে ছিল, সেটা বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন আমাদের শুধু নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ক্ষমতা আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এই ক্ষমতা ফেরত পেতে প্রস্তাব করেছি এবং আশা করি আমরা এটা ফেরত পাব।'
২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে কমিশনের এমন ক্ষমতা সীমিত করে দেয়, যা বিরোধী দলগুলোর মাঝে সমালোচনার জন্ম দেয়।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, ভোটগ্রহণের সময় অনিয়মের খবর পাওয়া গেলে কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেই কেবল নির্দিষ্ট কেন্দ্র বা একাধিক কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে কমিশনের।
২০১৮ সালে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নির্বাচন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। এরপরেই এ সংশোধনী আসে।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, একসময় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে একটি আসনের উপনির্বাচন বাতিল করেছিল ইসি। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে ফেরত দেওয়া যায় কিনা, তা যাচাই করতে আইনি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।'
আরপিও সংশোধন নিয়ে আলোচনা চলছে
কমিশনের গতকালকের সভায় আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হলেও তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি বলে জানান কমিশনার সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, 'পরবর্তী সভায় আরপিও সংশোধন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে।'
সভা-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কারের অংশ হিসেবে কমিশন আরপিও, নির্বাচন কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ আইন, হলফনামা, ইসি সচিবালয় আইন, ডাকযোগে ভোট, ইভিএম, দলীয় নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ নানা বিষয়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
সানাউল্লাহ আরও বলেন, প্রার্থী মনোনয়নের সময় হলফনামার প্রয়োজনীয়তা সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, 'ফৌজদারি মামলার বিবরণ ২০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রার্থীর আজীবনের রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।'
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ইসি। এবার প্রায় ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৬০২ জন নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। মৃত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে বাদ পড়েছেন ২১ লাখ ৩২ হাজার ৫৯০ জন।'
সম্পূরক ভোটার তালিকার খসড়া আগামী সপ্তাহে প্রকাশ করা হবে। দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তির পর আগস্টে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ইসির জনবল নিয়োগ এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা পরিবর্তন
সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য 'ইলেকশন কমিশন সার্ভিস' নামে একটি নতুন কাঠামো গঠনের বিষয়ে আলোচনা করছে কমিশন।
এদিকে বিদ্যমান বিধিবিধানই বলবৎ থাকবে। এছাড়া, ১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইনেও কিছু ছোটখাটো সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ চূড়ান্ত করছে কমিশন।
সানাউল্লাহ বলেন, '৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২২১ আসনের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি জমা পড়েনি। আমরা আশা করছি আগামী সপ্তাহে খসড়া সীমানা প্রকাশ করা হবে।'
তিনি আরও জানান, ঢাকার আসন সংখ্যা খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।
প্রবাসী ভোট ও ডাকযোগে ব্যালট পরিকল্পনা
প্রথমবারের মতো আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, '৪৮ কোটি টাকার একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে। প্রবাসীরা অনলাইনে আবেদন করবেন। সময়মতো ব্যালটপেপার ছাপিয়ে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
তিনি জানান, বিকল্প হিসেবে এমন 'ফাঁকা ব্যালট' দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে, যাতে ভোটার নিজ হাতে প্রার্থীর নাম লিখে দিতে পারেন। অথবা আগেই নির্দিষ্ট প্রতীকসহ ব্যালট ছাপিয়ে পাঠানো হতে পারে।
প্রবাসী ভোটারদের জন্য আলাদা একটি নিবন্ধন প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি বলেন, 'প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করা হবে।'
ইভিএম বন্ধের সিদ্ধান্ত
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) আর ব্যবহার না করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সানাউল্লাহ বলেন, 'ইভিএম নিয়ে কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য নেই, সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও তা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ইভিএম আর ব্যবহার হবে না।'
এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নিষ্পত্তির জন্য একটি আলাদা কমিটি গঠন করা হবে।
নতুন নির্বাচনী প্রতীক
এদিকে, 'শাপলা' প্রতীক ছাড়া ১১৫টি নতুন নির্বাচনী প্রতীকের একটি তালিকা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে এই প্রতীকগুলো কমিশনের অফিসিয়াল সূচিতে যুক্ত হবে, ফলে মোট প্রতীকের সংখ্যা ৬৯ থেকে বেড়ে হবে ১১৫টি।
কমিশন সূত্র জানায়, শুরুতে একটি কমিটি ১৫০টি প্রতীক প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছিল। পরে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় তা কমিয়ে ১১৫টি করা হয়।
এই সংশোধিত তালিকাটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রণালয় চাইলে এতে নতুন প্রতীক যোগ বা কিছু বাদ দিতে পারে।