৬৬৫ মিলিয়ন থেকে মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারে: বাংলাদেশ যেভাবে এক বছরে জ্বালানি বকেয়া প্রায় মিটিয়ে ফেলল

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আট মাসের মাথায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে এই বকেয়া বিল কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এটি ছিল ৬৬৫ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার।
পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, ওকিউটি-র কাছে থাকা বাকি ১ কোটি ডলার আজই (৩০ এপ্রিল) পরিশোধ করা হবে।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পেট্রোবাংলা ৯৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের এলএনজি আমদানির বিল পরিশোধ করেছে।
এর মধ্যে জেদ্দাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের মাধ্যমে চারটি স্পট মার্কেট সরবরাহকারীকে ৬২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার এবং কাতারএনার্জি এলএনজিকে ৩২ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে।
এই চারটি সরবরাহকারীর মধ্যে ভিটল এশিয়া পেয়েছে ২৮ মিলিয়ন ডলার, ওকিউটি পেয়েছে মোট ৩২ মিলিয়নের মধ্যে ২২ মিলিয়ন ডলার, এক্সেলেরেট এলপি পেয়েছে ৭ দশমিক ০৪ মিলিয়ন ডলার এবং গানভরসিঙ্গাপুর পেয়েছে ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
এলএনজি আমদানির বকেয়া পরিশোধ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীকাল [৩০ এপ্রিল] ওকিউটি-কে ১ কোটি ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ করা হবে। তখন আমরা সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হয়ে যাব।'
এর আগে, পেট্রোবাংলা শেভরন ও দুটি এফএসআরইউ অপারেটরের সব বকেয়া বিল পরিশোধ করেছে।

কার কত ঋণ ছিল?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন তেল ও জ্বালানি কোম্পানি শেভরনের কাছে বকেয়া ছিল ২৩৭ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধ করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহকারী কাতারএনার্জি এলএনজি এবং ওমান ট্রেডিং লিমিটেডের কাছে বকেয়া ছিল ৩১৭ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে পুরোটাই পরিশোধ করে ফেলা হয়েছে।
আট মাস আগে স্পট মার্কেট থেকে আমদানিকৃত এলএনজির বকেয়া ছিল ১১০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার, যা এখন নেমে এসেছে ১০ মিলিয়ন ডলারে।
দেরির কারণ কী?
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত তিন বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকায়, তেল ও এলএনজি সরবরাহকারীদের সঙ্গে লেনদেন জটিল হয়ে পড়ে। এর ফলে সময়মতো আমদানি বিল পরিশোধ সম্ভব হয়নি।
নগদ অর্থে তেল ও গ্যাস কেনা না যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে সরবরাহকারীরা মূল্য ও প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দেয়, কারণ তারা ধরে নিয়েছিল যে, বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধে ব্যর্থ হবে।
কীভাবে সম্ভব হলো পরিশোধ?
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টিবিএস-কে বলেন, সব বকেয়া পরিশোধ করতে কেবল সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল।
তিনি বলেন, 'দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমি আমদানি বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেই, কারণ এতে সরবরাহকারীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল এবং বিলম্বে পরিশোধের কারণে আমাদের বিশাল আর্থিক জরিমানা গুনতে হচ্ছিল।'
'এই খাতে অর্থের জোগান দিতে আমরা কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়েছি, যা বাজেটে জায়গা তৈরি করেছে। পাশাপাশি, পারফরম্যান্স বোনাস, ভাতা ও অনিয়ম-জালিয়াতিসহ অপচয়ের বিভিন্ন খাত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি,' যোগ করেন উপদেষ্টা।
তিনি আরও জানান, ব্যাংকগুলোর জন্য সভরেইন গ্যারান্টি নিশ্চিত করায় এগুলো ডলার জোগাড় করতে এবং বকেয়া পরিশোধে সহায়তা করতে পেরেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো—যেগুলো সাধারণত পেট্রোবাংলার অর্থ পরিশোধ করে—এভাবে হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ডলারের উৎস আকর্ষণে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকদেরকে কিছুটা বেশি হার প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় এই পরিবর্তন এসেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এ ছাড়ের ফলে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পেরেছে এবং তা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি বিল পরিশোধ সম্ভব হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'মূলত এটি তারল্য সমস্যা ছিল। যখনই আমরা ডলারের জন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিড করতে পারলাম, তখন থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ২৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অংশ ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বা মোটের ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরবর্তী তিন মাসে—অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে—ব্যাংক খাত রেমিট্যান্স পেয়েছে ৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পেয়েছে ২ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।