ঘূর্ণিঝড় ও পেমেন্ট জটিলতায় এলএনজি আমদানি ২৭% কমেছে; এলপিজি আমদানি বেড়েছে ১০.৫%

২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের জ্বালানি আমদানির ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি ১০.৫২ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমে গেছে ২৭.২৩ শতাংশ।
প্রায় ১.৮৬ লাখ টন এলএনজি আমদানি কমার মূল কারণ বৈরী আবহাওয়া ও অর্থ পরিশোধে (পেমেন্ট) জটিলতা। এর ফলে বাসাবাড়ি ও শিল্প খাতে বেড়েছে এলপিজি-নির্ভরতা।
জ্বালানি খাতের কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, দেশের দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি—যা সামিট গ্রুপ পরিচালনা করে—ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। প্রায় চার মাস এ টার্মিনালের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এলএনজি আমদানিতে।
বর্তমানে সামিটের ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এক্সিলেন্স—এই দুটি টার্মিনালই পুরোপুরি চালু থাকলেও এই দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকার কারণে বাসা, কারখানা ও শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছিল।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. শাহ আলম বলেন, 'ঘুর্ণিঝড় রিমালের সময় সামিটের এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এলএনজি সরবরাহ কয়েক মাস বন্ধ ছিল।'
'মেরামত হয়ে আসার পরও ফের সংযোগ পেতে আরও সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রায় চার মাস এই টার্মিনালে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমদানিতে,' বলেন তিনি।
পেট্রোবাংলার তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩.৮০ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে বিদ্যমান গ্যাসের চাহিদার ৩০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে এলএনজি।
এলপিজি ও এলএনজি উভয়ই প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে এলেও এদের গঠন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারে বড় পার্থক্য রয়েছে।
মূলত প্রোপেন ও বিউটেন দিয়ে গঠিত এলপিজি সাধারণ তাপমাত্রায় চাপে তরল অবস্থায় ছোট, সহজে বহনযোগ্য ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়। এটি মূলত রান্না, ঘর গরম রাখা ও যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যেখানে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ নেই এমন এলাকায়।
অন্যদিকে, এলএনজির প্রধান উপাদান মিথেন। একে অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় বড় তাপনিরোধক ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়। এলএনজি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখানা, জাহাজ ও ভারী পরিবহনের জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এলএনজি আমদানি হ্রাস
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪.৯৬ লাখ টন এলএনজি আমদানি করেছে, যা আগের বছরে ছিল ৬.৮২ লাখ টন।
আমদানি বাবদ খরচ ১ হাজার ২৫৮.৮৭ কোটি টাকা কমে ৩ হাজার ৪৪৬.৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছর অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৭০৫.৪৮ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি থেকে রাজস্ব আয় ১৮৮.৮৩ কোটি টাকা কমে ৫১৬.৯৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী উপকূলের দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সম্মিলিত রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা দিনে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলা মূলত কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। প্রতি চালানে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা হয়।
জ্বালানি কর্মকর্তারা বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি কমার একটি বড় কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল ৬৩৩ মিলিয়ন ডলার। এর ওপর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক না হওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির অনুমোদন আটকে ছিল।
বকেয়ার পরিমাণ বেশি থাকায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ও ৯ সেপ্টেম্বর দুই কার্গো এলএনজি খালাস না করে সরবরাহকারী দেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপে তা খালাস করা হয়।
তবে এলএনজির আমদানি বিল পরিশোধ-সংক্রান্ত জটিলতা এখন অনেকটাই কেটে গেছে বলে জানিয়েছেন আরপিজিসিএলের একজন উদ্ধতন কর্মকর্তা। ফের এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এলপিজি
চলমান সরবরাহ সংকটের কারণে আবাসিক ও শিল্প খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এলপিজি বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প জ্বালানি উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ১৩.৫৩ লাখ টন এলপিজি আমদানি হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ১২.১০ লাখ টন। গত পাঁচ বছরে আমদানি ক্রমাগত বেড়েছে। এলপিজি আমদানিতে বছরে প্রায় ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলপিজি আমদানির পরিমাণ ছিল ৯.৭৮ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১.৪০ লাখ টন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১.৩৭ লাখ টন।
লপিজি আমদানি পুরোপুরি বেসরকারি খাতনির্ভর। এসব চালান মূলত চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে আসে। প্রধান আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে ওমেরা পেট্রোলিয়াম, বসুন্ধরা এলপি গ্যাস, বেক্সিমকো এলপিজি, ডেল্টা এলপিজি, ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস, প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস, পেট্রোম্যাক্স এলপিজি, বিএম এনার্জি, মেঘনা ফ্রেশ এলপিজি ও যমুনা স্পেসটেক জয়েন্ট ভেঞ্চার। এসব প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই জ্বালানি কিনে থাকে।
অর্থমূল্যে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলপিজি আমদানি ১১ হাজার ৬৬৮.৮৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ১২০.৮৭ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৩২.৯৬ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৬০.৯৩ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৬৩৯.৮২ কোটি টাকা।
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও ডেল্টা এলপিজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, 'এলপিজি বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় খাত। প্রতিবছরই এর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে এলএনজিসহ গ্যাসের সংকট থাকার কারণে এলপিজির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। লাকড়ির চুলার পরিবর্তে এখন বাসাবাড়িতে এলপিজি ব্যবহৃত হয়। ছোট কলকারখানাগুলোতেও এর ব্যবহার বাড়ছে।'
শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রাক্কলন অনুসারে, আমদানিকৃত এলপিজির ৫০ শতাংশের ব্যবহার হয় বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে। অটোগ্যাস স্টেশন, যানবাহন, শিল্প বয়লারে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে বাকি অর্ধেক এলপিজি ব্যবহার হয়।
এলপিজি আমদানিতে কোনো শুল্ক না থাকলেও আমদানিকারকদের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। এই খাতটির বছরে প্রায় ১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।