এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ঘোষণা; কীভাবে এটা আন্দোলন থামাতে পারে?

দাবি আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের 'শাটডাউন' কর্মসূচির মধ্যে এনবিআরের আওতাধীন সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
রোববার (২৯ জুন) অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ আন্দোলনকে পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক উল্লেখ করেছে সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহের সকল শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস (Essential Services) ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আসলে কী?
অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বলতে সাধারণত সেসব পরিষেবাকে বোঝায়, যেগুলো ছাড়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই এশেনসিয়াল সার্ভিসেস (মেইনটেন্যান্স) অ্যাক্ট ১৯৫২ এবং এশেনসিয়াল সার্ভিসেস (সেকেন্ড) অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮ নামে দুটি আইন ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশও বহু বছর ওই আইন অব্যাহত রাখে।
২০২০ সালে শ্রম মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আইন করে। পরে ২০২৩ সালে আগের আইন রহিত করে সরকার অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন ২০২৩ প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করে। যেখানে কিছু চাকরি বা সেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা ঘোষণা করা হয়। এ আইনে ঘোষিত চাকরি বা পরিষেবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিধান যুক্ত করা হয়।
অত্যাবশ্যকীয় সেবা যেগুলো
বর্তমান আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রের ১৮ ধরনের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সেবা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ই-কমার্স এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল সেবা, ডিজিটাল আর্থিক সেবার মতো পরিষেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, সরবরাহ ও বিক্রি সেবা এবং এ সংক্রান্ত স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ কাজ। স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ ও আকাশ পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবা। বিমান ও বিমান বন্দর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ।
চোরাচালান প্রতিরোধ সম্পর্কিত পরিষেবা, সশস্ত্র বাহিনীর আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত পরিষেবা, দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশে প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালামাল উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পরিষেবাও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা হিসেবে ওই আইনে ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া রয়েছে খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, বিক্রয়, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মজুত, সরবরাহ বা বিতরণের কাজে নিযুক্ত সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিষেবা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি সম্পর্কিত পরিষেবা এবং ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ সংক্রান্ত পরিষেবা। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত পরিষেবাও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা। কয়লা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইস্পাত ও সার উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা।
তেলক্ষেত্র, তেল শোধণাগার, তেল সংরক্ষণাগার এবং পেট্রোলিয়াম বা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পরিষেবা।
সর্বশেষ টাকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণ কাজের সাথে সম্পর্কিত পরিষেবাও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা।
এসব পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যা করতে পারবে না
আইন অনুযায়ী এসব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সব শ্রেণির চাকরিজীবী কোনো ধরনের ধর্মঘট করতে পারবেন না।
ধর্মঘট বলতে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার একদল কর্মী একত্রে কাজ বন্ধ করা বা কার্যক্রম চলমান রাখতে অস্বীকৃতি জানানো বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ গ্রহণ করতে বা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানোকে বোঝাবে।
অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মালিকপক্ষও লকআউট বা লে-অফ ঘোষণা করতে পারবে না।
লকআউট বলতে কোনো মালিক কর্মস্থল বা কর্মস্থলের কোনো অংশ বন্ধ করে দেয় বা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কাজ বন্ধ রাখে বা চূড়ান্তভাবে বা শর্তসাপেক্ষে কোনো সংখ্যক কর্মীকে কাজের সুযোগ দেওয়ার অস্বীকৃতি জানানোকে বোঝাবে।
আর লে-অফ বলতে কয়লা, শক্তি বা কাঁচামালের স্বল্পতা বা মাল জমে থাকা বা যন্ত্রপাতি বা কলকব্জা বিকল হওয়া বা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে কোনো কর্মীকে কাজে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে মালিকের ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতাকে বোঝাবে।
কোন ধরনের সেবাকে সরকার অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে
আইনে উল্লেখ করা ১৮ ধরনের সেবার বাইরেও সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে বলে আইনে বলা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিবন্ধকতার কারণে জনকল্যাণমুলক সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এ ধরনের সেবাকে সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
এছাড়া জননিরাপত্তা বা জনগণের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এ ধরনের পরিষেবা, জনগণের অসহনীয় কষ্টের কারণ হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এ ধরনের কোনো পরিষেবা এবং দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারাদেশ বা দেশের কোনো অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় পরিষেবাকে সরকার চাইলে যেকোনো সময় অত্যবশ্যকীয় পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
এনবিআরের অত্যবশ্যকীয় সেবা ঘোষণার মেয়াদ হবে ৬ মাস
মূল আইনে উল্লেখ নেই, কিন্তু সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করেছে এমন সেবার অত্যাবশ্যকীয় মেয়াদ হবে ৬ মাস। তবে সরকার চাইলে প্রয়োজনে ওই মেয়াদ গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৬ মাস করে বাড়াতে পারবে।
এনবিআরের সেবা যেহেতু মূল আইনে উল্লেখ নেই, ফলে সরকার এই সংস্থার চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করলে তার মেয়াদ হবে ৬ মাস।
আইনে শাস্তি
অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কর্মীরা এ আইন অমান্য করলে অর্থাৎ ধর্মঘট করলে সর্বনিম্ন ৬ মাস কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
পাশাপাশি বেআইনি ধর্মঘটের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে কর্তৃপক্ষ। আর বিভাগীয় ব্যবস্থায় চাকরি থেকে অপসারণেরও দণ্ড রয়েছে।