ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় হরমুজ প্রণালী বন্ধের আশঙ্কা: ঝুঁকিতে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানি

ইরান-ইসরায়েলে পাল্টাপাল্টি হামলায় চলমান উত্তেজনার মধ্যে আন্তর্জাতিক সমুদ্র রুটের হরমুজ প্রনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে দেশের শিপিং কোম্পানিগুলো। এতে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
দেশ দুটির সশস্ত্র হামলার জেরে ইতিমধ্যে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইরান যদি হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে শিপিং কোম্পানিগুলো। ফলে চাপ পড়বে সাধারণ ভোক্তার পকেটে।
তারা বলছে, তেল সংকটের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাাঁচামাল ও এলএনজি সংকটের কারণে দেশীয় বাজারে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাঘাত এবং তেলনির্ভর প্রতিষ্ঠানের খরচ বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
একইসঙ্গে বাড়বে পণ্য পরিবহনের খরচ ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি, যার বোঝা বহন করতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকে।

বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজম যে চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে জাহাজ ঘুরপথে বিকল্প রুটে আসতে হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে।'
'এতে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ পুরোপুরি তেল আমদানিনির্ভর, সেসব দেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে,' যোগ করেন তিনি।
হরমুজ প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং করিডর। এ রুটে বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পরিবহন করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি রপ্তানির সময় সর্বক্ষণ ডজন ডজন ট্যাংকার হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রবেশ বা প্রস্থান করছে।
উত্তরে ইরান এবং দক্ষিণে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্বারা বেষ্টিত এই প্রণালী উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
আগামী মাসে তেলের দাম লিটারে ৪-৫ টাকা বাড়তে পারে: বিপিসি
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অপরিশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচারস-এর দাম ৯.০৭ শতাংশ বা ৬.২৯ ডলার বেড়ে প্রতি ব্যারেলের দাম ৭৫.৬৫ ডলারে উঠেছে। একপর্যায়ে দাম ৭৮.৫০ ডলারে পৌঁছায়, যা গত ২৭ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, যেভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে, এর প্রভাবে বাংলাদেশেও লিটারপ্রতি আগামী মাসে চার থেকে ৫ টাকা দাম বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, 'আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য মানতে হয়। প্রতি মাসে তেলের দামের মূল্য গড় করে মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে মনিটরিং করছি।'
বিপিসি আরও বলেছে, হরমুজ প্রণালী যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাবে। বিকল্প পথ হিসেবে লোহিত সাগর ও আরব সাগরের কথা চিন্তা করছে তারা।
তবে লোহিত সাগর রুটও ঝুঁকিমুক্ত নয়। বিগত সময়ে দেখা গেছে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের লোহিত সাগরে হামলার কারণে এই রুটও বন্ধ থাকে। তখন একমাত্র ভরসা আরব সাগর।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, 'যদি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, আশপাশের সমুদ্রসীমানা অরক্ষিত হয়ে পড়বে। জাহাজগুলোর রুট পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়ে যাবে। এর আগে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।'
৩৫-৪০ দিনের তেল মজুত রাখে বিপিসি
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, তাদের সব সময় বিভিন্ন ধরনের তেলের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মজুত থাকে, যা প্রায় ৪ লাখ টন।
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশ টিবিএসকে বলেন, ইস্টার্ণ রিফাইনারীতে ক্রুড তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন। সেই হিসাবে, সৌদি আরব থেকে বছরে ৬-৭ লাখ টন ও আবুধারি থেকেও একই পরিমাণ ক্রুড তেল আমদানি করা হয়। ১৪টি জাহাজে করে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন ক্রুড তেল আমদানি করা হয়।
এছাড়া পরিশোধিত তেল আমদানি করতে আটটি দেশের সাথে জি-টু-জি (সরকারি পর্যায়ে) চুক্তি আছে বিপিসির।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল ও বিমানের জ্বালানি তেলসহ বছরে মোট চাহিদা রয়েছে গড়ে ৭.২ মিলিয়ন টনের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ডিজেলের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি হয় ৬.৩৭ মিলিয়ন টন।