‘গোল্ডফিঙ্গার’ অ্যাল্পাইন সিকোয়েন্স যেভাবে বন্ডম্যানিয়ার জন্ম দিল

জেমস বন্ড জিরো জিরো সেভেনের দুনিয়াজোড়া খ্যাতির কথা কেই বা না জানে, কিন্তু আপনি কি জানেন যে এই বন্ডম্যানিয়ার যাত্রা শুরু হলো কোথা থেকে? কেনই বা বিশ্বসেরা সব ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি বন্ড সিরিজে দেখানো হয়? জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে ১৯৬৪ সালে।
সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালায় একজন সুপারভিলেন, একজন হত্যাকারী, একটি গতিদানব মাউন্টেইন চেস কার আর সেই সাথে নানা গ্যাজেটে সাজানো ঝা চকচকে অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি; দৃশ্যটি কল্পনা করতেই কি শিহরিত হচ্ছেন না? ১৯৬৪ সালে জেমস বন্ড সিরিজের তৃতীয় সিনেমা 'গোল্ডফিঙ্গার' এ ছিল এমনই একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য। কারো কারো মতে এই ৬ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির ইতিহাসে সবচেয়ে অদ্বিতীয় একটি মুহূর্ত।
সিনেমার প্রচারনার জন্য সে সময়ের হিসেবে এক অবিশ্বাস্য কৌশল অবলম্বন করেছিল 'গোল্ডফিঙ্গার' এর নির্মাতারা। 'সুইস আল্পস' নামে পরিচিত আল্পস পর্বতমালার যে অংশ সুইজারল্যান্ডে রয়েছে, সেখানে সাত দিনব্যাপী শুটিং এ তারা আমন্ত্রণ জানায় সব গণমাধ্যমকর্মীদের। নির্মাতারা চেয়েছিলেন যেন গণমাধ্যমকর্মীরা সিনেমার প্লট ও অন্যান্য সবকিছুই আগে থেকেই জেনে যায়। এর ফলে যা হল যে সিনেমা মুক্তির দুমাস আগেই নাম উঠে গেলো সংবাদপত্রে, নানা জল্পনা-কল্পনা হতে লাগলো সিনেমাটিকে ঘিরে। সিনেমার ক্ষেত্রে এরকম কৌশল বর্তমান যুগে কল্পনাই করা যায়না। যেখানে নির্মাতারা সিনেমার সামান্য আভাস দিতেও দ্বিধাবোধ করেন, সেখানে পুরো প্লট ফাঁস হবার পরেও 'গোল্ডফিঙ্গার' এর ব্যবসায়িক সফলতা ছিল আকাশচুম্বী!
সেই সাথে ওই সাত দিনে সাংবাদিকরা তুলেছিলেন শত শত 'বিহাইন্ড দ্য সীন' ছবি। পিটার ওয়েলটি প্রায় ২০০টির মত ছবি, কল শিট, স্ক্রিপ্ট, প্রোডাকশন ডকুমেন্ট ইত্যাদি নেন। পরে তিনি ও স্টিফেন অ্যাপেল মিলে এগুলো নিয়ে একটি বইও লিখেন।

এসব ছবির মধ্যে সর্বপ্রথম ছবিটি ছিল প্রয়াত জেমস বন্ড অভিনেতা শন কনারির, যেখানে তিনি মাথাভর্তি পাতলা চুল নিয়ে জুরিখ এয়ারপোর্টে এসে নামছেন। সবচেয়ে পরিচিত একটি ছবি ছিল অভিনেত্রী তানিয়া ম্যালেটের যিনি নিজের হাতে ধরে ছিলেন একটি সত্যিকারের এআর-সেভেন রাইফেল!
'অনেক বেশি পান করা'
বিখ্যাত এই সিকোয়েন্সটি আবর্তিত হয়েছে ম্যালেট অভিনীত চরিত্র টিলি মাস্টারসন এর সঙ্গে বন্ড এর মোকাবিলাকে ঘিরে। দুজনেই সিনেমার ভিলেন অরিক গোল্ডফিঙ্গারকে হত্যা করতে চান। প্রথম পদক্ষেপে টিলি মাস্টারসন ব্যর্থ হন এবং বন্ড তাকে ধাওয়া করে নিয়ে যান নিকটবর্তী এক গ্যারেজে।
এই দৃশ্যের শুটিং এর জন্য পরিচালক গাই হ্যামিল্টন বেছে নিয়েছিলেন সেন্ট্রাল সুইজারল্যান্ড এর আর্সেরেন ভ্যালির মধ্য দিয়ে যাওয়া 'ফুরকা পাস' কে। শুটিং চলাকালীন ৫০ জন কলাকুশলী আস্তানা গেড়েছিল পার্শ্ববর্তী ছোট্ট গ্রাম আন্দেরমাত এ।
গোল্ডফিঙ্গার সিনেমার এই বিখ্যাত সিকোয়েন্স এর মেকিং নিয়ে একটি বই লিখেন যিনি, সেই পিটার ওয়েলটি বলেন, "আশ্চর্যজনকভাবে আমরা সুইস সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েও গিয়েছিলাম। যদিও মিলিটারি ঘাঁটির কাছে হওয়ায় সে স্থানে সবসময় তারা দুজন পুলিশ নিযুক্ত রাখতো।"
ওয়েলটি শুটিং সেটের ডাক্তার থেকে শুরু করে বারম্যান সকলেরই প্রচুর ইন্টারভিউ নেন। শুটিং এর পর লেট নাইট হার্ড পার্টিও চলত খুব। হোটেল ব্যান্ড এর একজন সদস্য আর্থার ড্যানজার মনে করতে পারেন হ্যারল্ড সাকাতা নামের এক জাপানি-আমেরিকান অভিনেতাকে যিনি গোল্ডফিঙ্গারের হেঞ্চম্যান রূপে পর্দায় ছিলেন। এই হ্যারল্ড ছিল একজন রেসলার এবং সেখানের এক বড় আকর্ষণ।

ড্যানজার আরো জানায় যে ঐ এক সপ্তাহ শন কনারি প্রায় ঘুমাননি বললেই চলে। তাকে রাত তিনটায় শুতে যেতে হতো এবং পরেরদিন আবার সাতটায় উঠতে হত।
শন কনারি তখন ইতিমধ্যেই বিবাহিত হলেও ওয়েলটি তার বইয়ে জানিয়েছেন যে কোনো নারী সাংবাদিক তখন তার কাছ থেকে একটু হলেও বেশি মনোযোগ পেতেন!
বিখ্যাত ছবিসমূহ
নিজের যুদ্ধংদেহী আকর্ষণ এর জন্যে বিখ্যাত হলেও সকলেই শন কনারিতে মুগ্ধ ছিলেন না। এমনকি আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সিনেমা প্রোডাকশন তখন সেই এলাকায় হোটেলের বন্দোবস্ত করতেই ঘেমে গিয়েছিল। হাস্যকর হলেও সত্যি যে আন্দেরমাত গ্রামের সুইসরা ভেবেছিল যে এই ব্রিটিশদের সামর্থ্য নেই সেখানে থাকার! অথচ বর্তমানে কোনো গ্রামে জেমস বন্ড সিনেমার শুটিং হবে শুনলে গ্রাম ভেঙ্গে মানুষ জড়ো হওয়াই স্বাভাবিক।

তবুও মুক্তির আগেই মানুষের মধ্যে এই বন্ডম্যানিয়া তৈরি হয়ে যায়নি। ৩ মিলিয়ন বাজেটের 'গোল্ডফিঙ্গার' তখন আয় করেছিল ৪৬ মিলিয়ন ডলার।
বন্ড মুভির সফলতার জন্যে ওয়েলটি সেই অ্যাল্পাইন সিকোয়েন্সকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। শন কনারি মারা যাওয়ার পরেও সেই ফুরকা পাসে তার অ্যাস্টোন মার্টিন গাড়ীর সাথে দাঁড়ানো অনেক ছবি বের হয় যা ক্রমেই জেমস বন্ডের সিগনেচার ছবি হয়ে দাঁড়ায়।
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া