বিশ্বের ৮ কোটি শরণার্থীদের জন্য দৌড়েছেন তিনি

বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকটকে আমলে এনে গত অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো শরণার্থীদের একটি দলকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)।
'রিফিওজি অলিম্পিক টিম', সংক্ষেপে আরওটির অংশ হিসেবে এবারের টোকিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছেন জামাল মোহাম্মদ। সোমবার ৫০০০ মিটার দৌড়ের হিটে তৃতীয় হয়ে অল্পের জন্য বাদ পড়েছেন মোহাম্মদ।
অলিম্পিক দৌড়বিদ জামাল মোহাম্মদকে দৌড়াতে হয়েছে জন্মের পর থেকেই। তার বাবাকে যখন সুদানের সরকারপন্থী মিলিশিয়ারা হত্যা করে, তখনও জামাল শিশু। সেই বাচ্চা বয়সেই তখন তার সংসারের হাল ধরতে হয়।
২০১০ সালে সুদানের দারফুর থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন জামাল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনদিনের এই দুর্গম সফরে তিনি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন মিশরের সিনাই পর্বতও।
এখন ইসরায়েলের তেল আবিবে এসে নতুন জীবন শুরু করেছেন তিনি। জীবনভর দৌড়ে আসা জামাল দৌড়কেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে।
২০১৬ সালে ১০ জনের একটি ছোট দল নিয়ে অভিষেক ঘটেছিল শরণার্থী দলের। এবার সেই দলের অ্যাথলেট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯। এই ২৯ জনের দল অংশগ্রহণ করবে ১২টি আলাদা খেলায়।
হিটের আগে জামাল বলেছিলেন, 'আমি বিশ্বের ৮ কোটি শরণার্থীর জন্য দৌড়াচ্ছি, যাদেরকে ঠিকভাবে বাঁচার জন্য এবং নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে হয়েছে।'
'শরণার্থীরা অবশ্যই কোনো না কোনো কারণে তাদের দেশ ত্যাগ করে। আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে গর্বিত। আমাকে দেখে যেন তারা বুঝতে পারে, যে কোনো কিছুই সম্ভব। একদিন তারাও তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।'

রাজনীতির মারপ্যাঁচে শরণার্থীরা
আইওসির মোট ১১টি ভিন্ন দেশের অ্যাথলেট রয়েছে, যারা ট্রেনিং করছেন ১৩টি আয়োজক দেশে।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে চলমান এই অলিম্পিকে এই শরণার্থীদের গল্প ও অন্তর্ভুক্তি অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
গ্র্যান্ডি বলেন, '(করোনাকালে) আমাদের সবাইকেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে, আমাদের সবাইকেই একরকম নির্বাসনে থাকতে হয়েছে।
'আর এই তরুণ-তরুণীদের দেখুন, তাদের কোভিডের আগে থেকেই অনেক বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে, পরিবার ও প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা বইতে হয়েছে। তাদেরটা বাস্তব নির্বাসন। অলিম্পিকের উদ্বোধনীতে তাই তারা বলতে গেলে দুইরকম সংগ্রামের প্রতীক ছিল।'
মহামারির সময়ে ইউরোপে শরণার্থী সংকট আরও নাজুক হয়েছে। গ্রিসের মতো দেশগুলো সীমান্তে আরও কড়া পাহারা বসিয়েছে। ভূমধ্যসাগরে উদ্ধারকারী কোন সংস্থা কাজ করছে না। আর দেশে দেশে শরণার্থীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর কোয়েরেন্টিন ব্যবস্থা সমস্যাকে আরও গুরুতর করছে।
লকডাউন ও পরিবহন সংকট শরণার্থীদের জন্য চলাফেরা করা অনেক কঠিন করে তুলেছে।
গ্র্যান্ডি বলেন, 'বিবেকহীন রাজনীতিবিদদের বিদ্বেষ ও প্রোপাগান্ডার কারণে সবখানেই শরণার্থী ইস্যু অনেক উত্তপ্ত রূপ ধারণ করেছে।
'এই লোকগুলো আপনার দেশে আসতে চাচ্ছে, কারণ তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে পালিয়ে এসেছে, নিপীড়ন থেকে পালিয়ে এসেছে। আর তাদেরকে দেখা হয় এমনভাবে যেন তারা সমাজকে ধ্বংস করতে এসেছে, চাকরি চুরি করতে এসেছে, মূল্যবোধ নষ্ট করে দিতে এসেছে।
'শরণার্থীরা অনেক সুফলও নিয়ে আসে। তারা জাতিকে আরও সুগঠিত করে, অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে আর সার্বিকভাবে সমাজে বৈচিত্র্য আনে। আমার মনে হয় তাদেরকে এভাবেই দেখা উচিত আমাদের। এবং এই শরণার্থী দল সে বার্তাটিই পৌঁছে দিচ্ছে।'
শরণার্থী দল এখনো অলিম্পিকে কোন পদক জিতেনি। তাইকোয়ান্দোতে প্রথম তিনটি লড়াই জিতে সাবেক ইরানিয়ান অ্যাথলেট কিমিয়া আলিজাদেহ কাছাকাছি এসেছিলেন। পরের দুইটি লড়াই হেরে যাওয়ায় অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ মেডেলটি জিততে পারেননি তিনি।
শরণার্থী দলকে নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে গ্র্যান্ডি বলেন, 'বিশ্বজুড়ে ৮ কোটি ২৪ লাখ শরণার্থী রয়েছে। এটা তাদের সবার দল। এই দলের যে কোনো অর্জন তাই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রেরণার বার্তা দিবে।'
মেডেল না পেলেও, এই শরণার্থী অ্যাথলেটদের অংশগ্রহণ, শত বাধা পেরিয়ে যে আজ তারা এখানে এসে পৌঁছেছে, এটিই মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অনেক।
- সূত্র: সিএনএন