উদ্বাস্তু: প্রিয়জন ও ভিটেমাটিকে নীরবে বিদায় জানিয়ে যাওয়া

নিজের প্রিয় বাসাটায় তালা লাগিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হয় যে মানুষকে, তারাই শুধু বুঝতে পারেন উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট কতটা। আজ ইরানিরা তাদের সাজানো বাড়িঘর ফেলে যেভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন, কয়েকদিন আগে ঠিক এইভাবেই পালিয়ে গেছেন সিরিয়া, আরাকান ও ইউক্রেনের মানুষেরা।
ভালোবাসার স্মৃতি, ছবি, আসবাবপত্র, বই-খাতা, গাছপালা সব ফেলে রেখে মোটামুটি এক বস্ত্রে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়া। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না, কোথায় থাকবেন, কীভাবে থাকবেন তাও জানেন না। কবে ফিরে আসবেন জানেন না, জানেন না আদৌ ফিরে আসতে পারবেন কি না? আর সর্বোপরি ফিরে এসে নিজের বাসাটি এমন সাজানো-গোছানো পাবেন কি না? এভাবেই ঘরবাড়ি ও আশ্রয় হারিয়েছিল ফিলিস্তিন, সিরিয়ার মানুষগুলো।
বিশ্বের আরো অনেক দেশে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাড়াটাও ঠিক এভাবেই খালি হয়ে গিয়েছিল। ২৫ মার্চের কালরাতের পর থেকে পাড়াটা ক্রমশ খালি হয়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন একজন, দুজন করে বাড়িঘর ছেড়ে কাপড়ের পুটলি নিয়ে বা ট্রাংক-বেডিং নিয়ে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিলেন। কেউ যাচ্ছেন গ্রামে, কেউ ওপারে, মানে ভারতে। ছবিতে দেখেছি কেউ কেউ তাদের পোষা প্রাণীটিকেও সাথে করে নিয়ে চলেছেন।
বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলেছেন। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নৌকায়, কেউ অন্যের কাঁধে চেপে। এরা সবাই উদ্বাস্তু, ভিটেমাটি, গৃহ, পরিবার-পরিজন, গাছপালা, পালিত প্রাণী সবাইকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন ঠিক আজকের ইরানিদের মতো। এরাও কেউ জানতেন না কোথায় যাচ্ছেন, কে তাদের আশ্রয় দেবে? জানতেন না এ দেশে আর ফিরে আসতে পারবেন কি না?
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আমার বন্ধুরা তাদের পরিবারের সাথে একে একে চলে যাচ্ছিল। কে, কোথায়, কেন যাচ্ছিল সেটা তখন না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছিলাম সবার চোখে ভয় ও আতঙ্ক। আমাদের বাড়িওয়ালা খালাম্মা রাতের আঁধারে, চুলায় ভাত বসিয়ে আম্মাকে এসে বললেন, 'আমরা চলে যাচ্ছি কুমিল্লায়। তোমরা চাবিটা রাখো। আমার মেয়ে বড়, চারটা ছেলে এদের নিয়ে থাকা ঠিক হবে না।' কে নাকি এসে বলেছে সকালে পাড়ায় মিলিটারি আসবে। খালুও আব্বাকে ফিস ফিস করে কি যেন বলে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন।
আমার খুব কষ্ট হলো বিউটি আপার জন্য। বিউটি আপা তেঁতুল ও কাঁঠালের মুচি দিয়ে খুব মজার ভর্তা মাখতে পারতেন। আমার চুল বেঁধে দিতেন, গল্প শোনাতেন, ভাতও খাইয়ে দিতেন। সেসময় প্রতিবেশীরা ছিল আত্মার আত্মীয়। সবার সঙ্গে সবার পরিচয়, আন্তরিকতা ছিল আত্মীয়ের চাইতেও বেশি। স্বাধীনতার পর আর কখনো বিউটি আপাদের সাথে দেখা হয়নি। কারণ যুদ্ধ চলাকালেই এই ফাঁকা ভূতের গলি থেকে আমরা পাশে আরেকটি পাড়ায় চলে গিয়েছিলাম, যেখানে অন্তত কিছু পরিবার তখনো ছিল।
এভাবে পাড়া পুরো খালি হলো, শুধু আমরা তিন-চারটি পরিবার ঘর আটকে পড়ে রইলাম। আমি তখন খুব ছোট, ৬ বছর বয়স। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রিমওয়ালা আর আসছে না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকওয়ালা আসতো খেলা দেখাতে, একটা বাঁদর নাচওয়ালা ও একজন সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাতো। কিন্তু পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যাওয়ায় সবাই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বাতাসে চিরচেনা আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু গুমোট একটা অনুভূতি অনুভব করছিলাম। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাড়াটি সত্যিই যেন ভূতেরই গলি হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭১ সালে এমনিতেই ঢাকা ছিল একটি নিরিবিলি ও সুন্দর শহর। সেই শহর ফাঁকা করে যখন মানুষ দলে দলে গ্রামে চলে যেতে লাগল, তখন ঢাকা হয়ে পড়েছিল একটি ভুতুড়ে নগরী। বিকেল নামার সাথে সাথে খুব ঠান্ডা ও কুয়াশায় ছেয়ে যেত চারিদিক। চারিদিকে আলো ছিল টিমটিমে। মানুষের শোরগোল, কথাবার্তা, শিশুর কান্না কিচ্ছু শোনা যেত না। ঠিক যেন সেই ছড়ার মতো-
'খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে।'
নিজের ভিটেমাটি ছাড়ার আগে ইরানিরা সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন 'দ্য লাস্ট ফটো অব হোম', অর্থাৎ বাড়ির শেষ ছবি। যেসব মানুষ নিজেদের বাড়িতে তালা লাগিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তারাই এ ধরনের ছবি শেয়ার করছেন। ছবিগুলো দেখে চোখে পানি এল। বুকটার মধ্যে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হলো। বারবার মনে হতে থাকল ওই মানুষগুলোর কথা, যারা ভালোবাসার জিনিসগুলো পেছনে ফেলে প্রাণ নিয়ে ছুটে চলেছেন।
যে মানুষটি তার বাড়ির ছবি দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে খালি পড়ে থাকা একটা সোফা, তার সামনে স্যুটকেসে জিনিসপত্র ভরে রাখা আছে।
জানালাগুলোর পর্দা নামানো আর তার পাশেই রাখা ঘরোয়া গাছের টব, কিছু ঘর সাজানোর জিনিস আর সোফার কুশন যত্ন করে সাজিয়ে রাখা। তিনি বা তারা নিশ্চিত নন যে ঘরে ফিরে এসে নিজেদের বাড়িঘর অক্ষত পাবেন কি না।
কিছু বাড়িঘর ইতোমধ্যেই ইসরায়েলি হামলায় তছনছ হয়ে গেছে। একজন লিখেছেন, "প্রিয়জনদের কাছ থেকে পাওয়া ছোটখাটো উপহার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছি। গাছগুলোতে জল দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করাটা খুব কঠিন, বিশেষ করে আপনি যখন নিশ্চিত নন যে কখনো ফিরতে পারবেন কি না। নীরবে বিদায় জানালাম।''
ইরানের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন যে তারা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের কারও বৃদ্ধ বাবা-মা বা ছোট শিশুরা আছেন, কারও আবার চিকিৎসার প্রয়োজন আছে অথবা কারও হয়ত বিকল্প কিছুই নেই।
একজন নারী বিবিসিকে বলেন, তিনি গর্ভবতী আর তার একটি ছোট মেয়ে আছে, "যানজটের এই অবস্থার মধ্যে আমি কি বাঁচতে পারব? যা কিছু গড়েছি আমি, সবই তো এখানে... আমি কোথায় যাব? সত্যি বলতে, এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে আমি ভাবতেই পারছি না যে চলে যাওয়ার পরে ফিরে এসে যদি দেখি যে আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে।"
আমরা যারা ১৯৭১ এ অবরুদ্ধ ঢাকায় ছিলাম, তারাও এরকম কারণেই পালিয়ে যেতে পারিনি। থেকে গিয়েছিলাম পাকিস্তানিদের হামলা ও দুঃশাসনের মধ্যে।
অন্য একজন ইরানি বলেছেন, ''কখনো এত দুঃখ হয়নি। জানি না আর কোনো দিন ফিরতে পারব কি না।" আরেকজন সামাজিক মাধ্যমে তার কাজ করার টেবিল, কম্পিউটার আর একজোড়া হেড-ফোনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, "যেসব জিনিসগুলো পেতে এত পরিশ্রম করেছি, সেগুলোকে বিদায় জানালাম। এগুলো পেতে কত রাত জাগতে হয়েছে, মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। আশা করি যখন আমি ফিরে আসব, এগুলো এখানেই থাকবে।"
অহেতুক ক্ষমতা প্রদর্শনের নিমিত্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন হানাহানিতে মেতে ওঠে, তখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের মানুষরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন। তাদের আয়, ব্যয় ও বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে বাধ্য হন তারা। ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে এই ছুটে চলা।
অনেকে লিখছেন, "কত স্নেহ দিয়ে আর পরিশ্রম করে বাড়ির জন্য কত কিছু কিনে ঘরটা সাজিয়ে তুলেছিলাম। একদিনে আমার এই সুন্দর নিরাপদ আশ্রয়টায় ফিরে আসব, এই আশা নিয়েই আমি নীরবে বিদায় জানালাম।"
যুদ্ধবাজ নেতারা বুঝতেই চান না যে মানুষ কী হারায়, কাকে হারায়। শিশুরা কতটা বিপর্যস্ত হয়। গাজার শিশুরা আর কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে বলে মনেহয় না। সিরিয়ার মতো ঐতিহাসিক একটি দেশ বা সভ্যতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। মানুষ, গাছ, পাখি এক ফুৎকারেই ছাই হয়ে গেল। গাজা, সিরিয়ার শিশুরা পথের ধারে উদ্বাস্তু হয়ে দিন কাটাচ্ছে। আহার, মাথা গোঁজার ঠাঁই, ওষুধ, সেবা, ভালোবাসা, পরনের কাপড়, শিক্ষা কিচ্ছু নেই তাদের, অথচ একদিন সব ছিল।
২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩২ লাখে, এর মধ্যে তিন কোটি ৬৮ লাখ ছিল শরণার্থী। অন্যদের মধ্যে রয়েছে আশ্রয়প্রার্থী (৮৪ লাখ) এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি (৭ কোটি ৩৫ লাখ)।
উল্লেখ্য, গত দশকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে সিরিয়ায় (এক কোটি ৩৮ লাখ)।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর এত অত্যাচার করে চলেছে যে এই মানুষগুলোও আজ উদ্বাস্তু। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সবকিছু ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। এখানে খুব কষ্টে দিন কাটছে তাদের। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ, দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, কাজের সংকট। পাশাপাশি এরা জড়িয়ে পড়ছে নানাধরণের অপরাধমূলক কাজে। বাস্তুচ্যুত হয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অসহায় ও অপরাধী হয়ে উঠছে।
এভাবেই ইউক্রেন, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানের মতো ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশগুলো সব হারিয়ে গেল। এই দেশগুলো মানচিত্রে থাকলেও, জীবনে নেই। এখানকার মানুষগুলোর পরিচয় হচ্ছে ''উদ্বাস্তু"। আহা খুব মায়া লাগে এই মানুষগুলোর জন্য। কবি অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত এর ভাষায় বলতে হয়-
''পথচারীদের হটিয়ে দিয়ে, তফাৎ ক'রে দিয়ে
সমস্ত সামনেওয়ালাকে পিছনে ফেলে
পর-ঘর বিদেশী বানিয়ে।
হ্যাঁ, ওরাও উদ্বাস্তু।
কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে।"
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক