পাণ্ডুলিপি ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’: একাত্তরের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা
মেহেরুন্নেসাদের বাড়িটিতে এখন আর কেউ থাকেন না। থাকার উপায়ও নেই—একাত্তরের ২৭ মার্চ পাক বাহিনীর দোসররা তার দুই ভাই, মা ও তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এত নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল যে তার বর্ণনা দিতেও বুক কেঁপে ওঠে।
কবি মেহেরুন্নেসার জীবন থেমে যায় মাত্র উনত্রিশে। যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, কবিতায় তার খ্যাতি আরও বিস্তৃত হতো—এ কথা দৃঢ়ভাবেই বলা যায়। অল্প সময়ে তিনি যা লিখে গেছেন, তার দ্যুতি আজও কম নয়। উদাহরণ হিসেবে তার কয়লাখনির শ্রমিকদের জীবন নিয়ে লেখা একটি কবিতা তুলে ধরা যায়:
কয়লা খনির গভীরে দেখেছি জ্বলতে
জ্বালানীবিহীন মহাজীবনের সলতে
তবুও কখনো ওদের শুনিনি বলতে
আমরাও জানি জীবন নাট্যঘরে
বাঁচার খেলা খেলতে।
পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই মেহেরুন্নেসার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে ইত্তেফাক, বেগম, দৈনিক পাকিস্তান, মাসিক মোহাম্মদী, ললনাসহ নামীদামি পত্র-পত্রিকায়। ১৯৫৪ সালে লেখা তার 'রাজবন্দী' কবিতায় উচ্চারিত হয় দাবির আগুন—'আমাদের দাবি মানতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' মাত্র ১২ বছরের এক কিশোরীর এমন প্রতিবাদী উচ্চারণ গোয়েন্দাদের নজরে আসে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে বাড়িতেও পৌঁছায়। বয়স জেনে হতবাক হয়ে তারা ফিরে যান, তবে সতর্ক করে দিয়ে যান—সরকারবিরোধী কবিতা যেন আর না লেখে। কিছুদিন লেখা থেমে থাকলেও কবির কলম কি থেমে থাকে? মেহেরুন্নেসাও পারেননি।
মেহেরুন্নেসার বড় বোন মোমেনা খাতুন তার 'সূর্যজ্যোতির পাখি' নামের পাণ্ডুলিপিটি জমা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ফলে নতুন প্রজন্মের জানার পথ খুলেছে মুক্তিকামী এই সাহসী কবিকে। তার জীবন ও সৃষ্টির দলিল হয়ে আছে কবি কাজী রোজীর লেখা জীবনীগ্রন্থ শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, যা প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।
পরিবার-পরিজনের কাছে তিনি ছিলেন সকলের আদরের রানু। চঞ্চলা, প্রাণবন্ত, হাতের কাজে দক্ষ, আবার গানেও ছিলেন পারদর্শী। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, নজরুলের সঞ্চিতা, জসীমউদ্দীনের কবিতা—সবই ছিল তার প্রিয় পাঠ।
দেশের মানুষের দুঃখ তাকে ব্যথিত করত। মন-মানসিকতায় ছিলেন মুক্ত—কবিতাতেও পাওয়া যায় সেই মুক্তির পথচিহ্ন। উনসত্তর, সত্তর থেকে একাত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছেন। তাই প্রথম দিকের কবিতায় ধর্মীয় আবহ থাকলেও পরের সময়ে তার কবিতা হয়ে ওঠে দীপ্ত সংগ্রামের ভাষা। ভাষা শহীদদের স্মরণে তার কলম বলে ওঠে—
শহীদ ভাইরা স্বর্গ শিখর হোতে
চোখ মেলে দ্যাখো আজ বাংলার
পীচমোড়া কালো পথে
তোমাদের যতো উত্তরসূরী
বুলেটের মুখে হাসে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে মকবুলা মনজুর ১৯৭২ সালের জুন মাসে দৈনিক বাংলায় লিখেছেন– 'মেহেরুন্নেসা উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে, সত্তরের মিছিলে, একাত্তরের অসহযোগে আগুনের শিখা হয়ে জ্বলেছেন। উনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে মেহেরুন্নেসা পড়েছিলেন তার সেই অবিনাশী কবিতা- "প্রভু নয় বন্ধু কে"। প্রশ্নের শাণিত তরবারি হয়ে সেদিন তার কবিতা আয়ুবশাহীর নিরেট ভিত্তিকে চিরে চিরে দেখতে চেয়েছিল। শুধু এই কবিতাটিই নয়, আরও অনেক কবিতা মেহেরুন্নেসা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আগুনের ফুলকির মতো।'
মেহেরুন্নেসার শেষ কবিতা ছাপা হয়েছিল বেগম পত্রিকায়, ১৯৭১ এর ২৩ মার্চে। কবিতাটির নাম ছিল 'জনতা জেগেছে'—
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা
আমরা ভেঙেছি জয় বাংলার
যতো বিজয়ের বাঁধা।
এই ভয়হীন, শক্তিশালী কবিতা তাকে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড' থেকে জানা যায়, একাত্তরের ২৩ মার্চেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত বিপ্লবী কবিতাপাঠের আসরে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবিরসহ অন্যান্য কবিদের সঙ্গে মেহেরুন্নেসাও স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন। ড. আহমদ শরীফ এ আসরে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
মেহেরুন্নেসা ছিলেন এক উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য। তার জন্ম ১৯৪২ সালে কলকাতার খিদিরপুরে। তখনকার সমাজের চরিত্র অনুযায়ী তারও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বড় বোন মোমেনা খাতুন কিছু পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন, আর তা সম্প্রদান করেছিলেন মেহেরুন্নেসাকে।
তাদের পরিবার একসময় স্বচ্ছল ছিল। কলকাতার কালীবাজারে কাপড়ের দোকান আর ভবানীপুরে জুতার দোকান ছিল তাদের। কিন্তু সাতচল্লিশের দাঙ্গায় দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, লুট হয় সবকিছু—ফলে পরিবার হয়ে পড়ে নিঃস্ব। জীবিকার প্রয়োজনে তখন শিশু মেহেরুন্নেসাকে বাবার সঙ্গে কয়লার দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর টিকতে না পেরে পরিবার ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসে।
প্রথমে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে ছোট্ট একটি ভাড়াবাড়িতে ওঠেন তারা। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় কাগজের ব্যবসা শুরু করেন মেহেরুন্নেসার বাবা, কিন্তু তাতেও সাফল্য আসেনি। পরে তিনি নাবিস্কোতে অল্প বেতনে চাকরি নেন, তারপর হক কোম্পানিতে যোগ দেন। এদিকে বড় মেয়ে মোমেনার বিয়ে হয় সুশিক্ষিত ও স্বচ্ছল পরিবারে।
এর মধ্যেই মেহেরুন্নেসার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সংসারের হাল ধরতে নতুন সংগ্রাম শুরু হয় মেহেরুন্নেসার। মা, ছোট দুই ভাই রফিক ও টুটুল—সবার দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রয়োজন হয় স্থায়ী ঠিকানারও। তিনি বাংলা একাডেমিতে অনুলিখনের কাজ নেন, একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরে কাজ নেন ফিলিপস রেডিও কোম্পানিতে, পাশাপাশি ইউএসআইএস লাইব্রেরিতেও অনুলিখন করতেন। ফিলিপসে তখন মুখপত্র ছাপা হতো ইংরেজি ও উর্দুতে; তার উদ্যোগেই শুরু হয় বাংলাতে মুখপত্র প্রকাশ। 'রানু আপা' ছদ্মনামে তিনি লিখতেন রাজনৈতিক প্রবন্ধ—আয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনের দিনগুলোতে তার কলম ছিল সাহসের প্রতীক।
পরবর্তীতে তিনি বাবার নামে মিরপুরে বাড়ি বরাদ্দের চেষ্টা চালান এবং সফলও হন। সে সময় কবি কাজী রোজীর নেতৃত্বে মিরপুরে গড়ে ওঠে অ্যাকশন কমিটি, যার সক্রিয় সদস্য ছিলেন মেহেরুন্নেসা।
মুক্তিকামী ভূমিকার কারণে অবাঙালি উন্মত্ত গোষ্ঠীর নজরে আগেই পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, তবু দমে যাননি। দুই ভাই রফিক ও টুটুলকে সঙ্গে নিয়ে অংশ নিয়েছেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচিতে—জয় বাংলার স্লোগানে উত্তাল করেছেন পথ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি ছিলেন জনতার প্রথম সারিতে। ২৩ মার্চ সকালে নিজের বাড়িতে তিনি উত্তোলন করেন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।
এতো সাহস কোথায় পেয়েছিলেন মেহেরুন্নেসা। সেকালে মিরপুরের মতো জায়গায় বাস করেও তিনি ছিলেন নির্ভীক ও সক্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বললেন, "উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য হিসেবে লড়াই করেই বড় হয়েছেন। তাই ধরে নেওয়া যায় সাহস ছিল তার সহজাত।"
আরও বললেন, "সুফিয়া খালাম্মা (কবি সুফিয়া কামাল) তাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন নারী কবির সংখ্যা খুব বেশি ছিলে না, যে অল্প কয়েকজন ছিলেন তাদের মধ্যে মেহেরুন্নেসাকে আলাদা করা যেত।"
"তার কবিতায় সাহস যেমন ছিল, তেমন ছিল সৌন্দর্য। তাই শিল্প সংস্কৃতির জগতে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। তদুপরি, তিনি একজন নারী আর ঘাতক দল তাতেই ছিল ক্ষিপ্ত; সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তারা, স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই তিনি তাদের হিংস্রতার শিকার হন," যোগ করেন মফিদুল।
মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের মুকুল ফৌজ মাঠের ধারে ছিল মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি। বাড়িটি এখন বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। তরুণরা হয়তো তার কথা শোনেননি। তবে প্রবীণদের মধ্যে অনেকেই মনে রেখেছেন তার কথা এবং বেদনা বোধও করেন।
বাড়িটির এক বাসিন্দা বললেন, "কবির পরিবারের সদস্যরা পরের দিকে মিরপুর ১১ নম্বরে চলে গিয়েছিলেন। তাও অনেকদিন আগের কথা। এখন তাদের খবর আমরা জানি না।"
মেহেরুন্নেসা সাহসের নাম, শক্তির নাম, সৌন্দর্যের নাম। ইতিহাস থেকে মুছে যাবেন তা মনে হয় না। নিজের শক্তিতেই তিনি ইতিহাসের পাতায় দাগ কেটে যাবেন অন্তত যতদিন বাংলাদেশ থাকবে।
