মোহাম্মদপুরে জোড়া খুন: সন্দেহভাজন এখনও পলাতক, অতীতেও ছিল চুরির রেকর্ড
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় এক নারী ও তার কিশোরী মেয়েকে হত্যার অভিযোগে আয়েশা নামের এক গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তদন্তে ওই গৃহকর্মীর অতীত সম্পর্কে একাধিক উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে, যা তাকে অন্য বাসাবাড়ির জন্যও সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, আয়েশা এর আগেও যেসব বাসায় কাজ করেছিল, সেসব বাসা থেকে অন্তত দুইবার চুরি করে পালিয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, মোহাম্মদপুরের ঘটনাটিও আবার চুরি করার সময় ধরা পড়ে যাওয়ার পর ঘটতে পারে।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, আসামিকে গ্রেপ্তারের আগে হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না এবং বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নিহতদের স্বামী গৃহকর্মীকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। হত্যাকাণ্ডটি চুরির উদ্দেশ্যে নাকি অন্য কোনো কারণে ঘটেছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।'
নৃশংস হত্যাকাণ্ড
গত সোমবার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের ৩২/২এ নম্বর বাসার সপ্তম তলায় এই ঘটনা ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, আয়েশা ওই বাসার গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে (১৫) কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
দুজনের রক্তাক্ত মরদেহ আলাদা স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। সকাল পৌনে ১২টার দিকে বাসার ভেতর থেকে লায়লা আফরোজের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বাসার মেইন গেটের কাছে পড়ে থাকা নাফিসাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে নৃশংসতার ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লায়লা আফরোজের শরীরে গলার আঘাতসহ মোট ৩০টি জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়। অন্যদিকে নাফিসার শরীরে ছয়টি গভীর কাটা জখম ছিল।
সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুরে চার দিন আগে কাজ নেওয়ার সময় আয়েশা দাবি করেছিল, তার বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন এবং আগুনে সে নিজেও আহত হয়। তার মুখ ও গলায় পোড়া দাগ ছিল। এই বর্ণনার সঙ্গে সাত থেকে আট মাস আগে একই ধরনের পোড়া দাগযুক্ত এক গৃহকর্মীর মোহাম্মদপুর এলাকায় চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার মিল পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষের ধারণা, আগের চুরির ঘটনাগুলো এবং বর্তমান এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি একই হতে পারে।
এ ঘটনায় নাফিসার বাবা আ. জ. ম. আজিজুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তিনি উত্তরার সানবিমস স্কুলের শিক্ষক।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, আসামি চার দিন আগে তার বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। সোমবার সকাল আনুমানিক ৭টার দিকে তিনি উত্তরায় তার কর্মস্থলে চলে যান। কর্মস্থলে অবস্থানকালে তিনি একাধিকবার তার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
পরবর্তীতে বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে তিনি বাসায় ফিরে দেখেন, তার স্ত্রী গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর কাটা জখম নিয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন এবং তার মেয়ে গলার নিচে ডান পাশে কাটা গুরুতর আহত অবস্থায় বাসার মেইন গেটের কাছে পড়ে আছে।
বাড়ির পরিচ্ছন্নকর্মীদের সহায়তায় তাৎক্ষণিক উদ্ধার প্রচেষ্টা চালানো হলেও নাফিসাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এজাহারে তিনি আরও বলেন, বাসার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বাসায় আসে এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে তার মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় সে একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চ্যালেঞ্জ, আতঙ্কে এলাকাবাসী
পুলিশ, ডিবি, পিবিআই, সিআইডি, র্যাব ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আয়েশাকে গ্রেপ্তারে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে। সোমবার রাত থেকে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হলেও এখনও পলাতক রয়েছে ওই গৃহকর্মী।
তদন্তকারীরা সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে তার পালানোর পথ শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। তবে সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় তদন্ত কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় অসংখ্য গৃহকর্মী থাকলেও তাদের অনেকের পরিচয় সংরক্ষিত নেই। পাশাপাশি এলাকাটি অপরাধপ্রবণ হওয়ায় আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জুয়েল রানা গৃহকর্মীদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংরক্ষণ এবং ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ করে থানায় জমা দেওয়ার জন্য বাড়ির মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি জোরদার করা জরুরি।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মোহাম্মদপুর এলাকাবাসীকে হতবাক ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। পরে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং দাফনের জন্য নাটোরের বড়গাছা গ্রামের পারিবারিক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
কর্তৃপক্ষ আয়েশার কথিত বাড়ি রংপুর এবং আগুনে পোড়ার দাবিসহ সব দিক খতিয়ে দেখছে। তার উদ্দেশ্য উদ্ঘাটন এবং ভবিষ্যতে এমন অপরাধ প্রতিরোধে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
