জ্যঁ ক্যা: মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের সাহায্যে পাকিস্তানের বিমান ছিনতাই করেছিলেন যে ফরাসি
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে তখন চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ঠিক আগমুহূর্ত, চলছে তুমুল যুদ্ধ। ঠিক সেই সময়েই হাজার মাইল দূরে প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে ঘটেছিল এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। তৎকালীন 'পূর্ব পাকিস্তানের' অসহায় শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে এক ফরাসি যুবক জিম্মি করেছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) আস্ত একটি যাত্রীবাহী বিমান।
লন্ডন থেকে প্যারিস হয়ে করাচিগামী পিআইএ-এর বোয়িং ৭২০-বি বিমানটি সেদিন সকাল ১১টা ৫ মিনিটে অরলি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ফ্লাইট নম্বর পিকে-৭১২। বিমানের গায়ে লেখা 'সিটি অব কুমিল্লা'। বিমানে যাত্রী ও ক্রু মিলিয়ে মোট আরোহী সংখ্যা ২৮ জন।
ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা ৪৫ মিনিট। বিমানটি তখনও প্যারিসের রানওয়েতে, এখান থেকে উঠেছেন আরও পাঁচ যাত্রী।
শেষ যাত্রী হিসেবে বিমানে ওঠেন জ্যঁ ইউজিন পল ক্যা—আলজেরীয় বংশোদ্ভূত এক ফরাসি নাগরিক। তার হাতে ছিল কেবল একটি বাদামি রঙের ব্রিফকেস।
বিমানটি রানওয়েতে চাকা গড়াতে শুরু করলেই তিনি নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। নাইন এমএম পিস্তল বের করে তিনি সোজা ককপিটে ঢুকে পড়েন। তার হাতে থাকা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল বৈদ্যুতিক তার, যা দেখিয়ে তিনি হুমকি দেন—দাবি না মানলে পুরো বিমানটিই উড়িয়ে দেওয়া হবে।
বিমান থামাতে বাধ্য হন পাইলট। জ্যঁ ক্যা নির্দেশ দেন পাইলটকে বিমানের ফুয়েল ট্যাংক কানায় কানায় পূর্ণ করতে।
সাধারণত বিমান ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণ বা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চায়। কিন্তু জাঁ ক্যা-এর দাবি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ছিনতাইয়ের ১০ মিনিট পর জ্যঁ ক্যা রেডিওর মাধ্যমে প্রথম বার্তা পাঠান এটিসিতে। নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সমর্থক হিসেবে। জানান, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিশু ও শরণার্থীদের জন্য বিমানের সমপরিমাণ অর্থ ও ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণ সামগ্রী দিতে হবে, অন্যথায় বিমানসহ সব আরোহীকে ব্রিফকেসে থাকা বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
কিছুক্ষণ পর অবশ্য অর্থের দাবি থেকে সরে আসেন। দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে জ্যঁ ক্যা ককপিটের জানালা দিয়ে একটি চিরকুট পাঠান। আল্টিমেটাম দেন—দুই ঘণ্টার মধ্যে ২০ টন ওষুধ (ভ্যাকসিন, ভিটামিন ও অ্যাম্ফিটামিন) বিমানের পেছনের অংশে লোড করতে হবে। এরপর তিনি কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বিমান জিম্মির ঘটনায় চারদিকে পড়ে যায় হই হই। প্যারিসের এসোন ডিপার্টমেন্টের প্রিফেক্ট মিশেল অরিয়াক এবং বিমানবন্দর পরিচালক গিলবার্ট ড্রেইফাস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর নির্দেশ আসে—কোনোভাবেই যেন রক্তপাত না ঘটে।
মেনে নেয়া হয় জ্যঁ-এর দাবি। তবে কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়। তারা জ্যঁ ক্যা-কে জানায়, ফ্রান্স সরকার এবং 'অর্ডার অব মাল্টা'র সৌজন্যে ওষুধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তবে তা পৌঁছাতে বিকেল সাড়ে ৪টা বেজে যাবে।
এরই মধ্যে কৌশলে রেড ক্রসের সহায়তায় বিমানের অসুস্থ, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীদের নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়।
বাইরে যখন ওষুধের ট্রাক আসার অপেক্ষা, তখন আড়ালে চলছিল পুলিশের শ্বাসরুদ্ধকর প্রস্তুতি। এয়ার ফ্রান্সের পার্কিং জোনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি বোয়িং বিমানে মহড়া দিচ্ছিল পুলিশ। তাদের পরিকল্পনা ছিল বিমানের 'নোজ গিয়ার' বা সামনের চাকার সঙ্গে থাকা গোপন 'ট্র্যাপ ডোর' দিয়ে ককপিটে প্রবেশ করা। সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে এই পথটি লাগেজ হোল্ড হয়ে কেবিনের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
ভার্সাই থেকে আসা পুলিশের বিশেষ দল এবং স্নাইপাররা চূড়ান্ত অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। বিকেল ৫টা ১৬ মিনিটে ওষুধের একটি ছোট ট্রাক বিমানের পাশে এসে দাঁড়ায়। রেড ক্রসের পতাকা হাতে দুজন লোক বিমানটির কাছে যান। ওষুধ লোড করার প্রক্রিয়াটি পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ধীরগতিতে করতে থাকে।
৭টা ১৪ মিনিট। ওষুধের কার্টন লোড করার ভান করে রেড ক্রসের জ্যাকেট ও আর্ম ব্যান্ড পরে চারজন ফরাসি পুলিশ কর্মী সেজে বিমানের পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। ঠিক একই সময়ে এয়ার ফ্রান্সের টেকনিশিয়ান সেজে আরও দুজন পুলিশ ককপিটের গোপন দরজা (ট্র্যাপ ডোর) দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।
রেড ক্রসের ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ সদস্য হঠাৎ জ্যঁ ক্যুয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। জ্যঁ ক্যাও পাল্টা গুলি চালান। তার পিস্তলের গুলি এক পুলিশ অফিসারের সোয়েটার ভেদ করে হাতে সামান্য আঘাত করে। ট্র্যাপ ডোর দিয়ে আসা পুলিশরাও তখন ধস্তাধস্তিতে যোগ দেন। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর অবশেষে জ্যঁ ক্যাকে কাবু করা সম্ভব হয়। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার জিম্মি নাটকের।
জ্যঁ ক্যা গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশ তার সেই রহস্যময় বাদামি ব্রিফকেসটি খুলে দেখে। যেটিকে তিনি বোমা বলে ভয় দেখাচ্ছিলেন, তার ভেতরে পাওয়া যায় একটি বাইবেল, একটি ইলেকট্রিক রেজার, জুতোর ব্রাশ আর দুটি তার। কোনো বিস্ফোরক সেখানে ছিল না।
ঘটনার পর তার ঠিকানা হয় ফ্লুরি-মেরোগিস কারাগারে। ৫ বছর সাজা হওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় দুই বছর পরই মুক্তি পান জ্যঁ ক্যা।
অবশ্য বিমান ছিনতাইয়ে ব্যর্থ হলেও নিজের দাবি আদায়ে সফল তিনি। রেড ক্রসের কল্যাণে সেই ২০ টন ওষুধ আর ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে যায় বাংলাদেশের শরনার্থী শিবিরে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে জাঁ ক্যা-এর এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ সেদিন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আজ ৫৪ বছর পর, ৩ ডিসেম্বরের এই দিনে আমরা স্মরণ করি সেই ফরাসি যুবককে, যিনি মানবতার খাতিরে নিজের জীবন বিপন্ন করে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশে।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, হিস্টোরি অব পিআইএ, ল্য মোঁদ
