১৯৭১: বিশ্ব যখন পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে রেষারেষি ও স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। সঙ্কটময় সেই মুহূর্তে নিজ নিজ মিত্রদের পক্ষে অবস্থান নিতে দুই দেশই তখন সামরিক ও কূটনৈতিক চাল চালছিল, এমনকি সমুদ্রে নৌবাহিনী মোতায়েনও করা হয়েছিল। পরাশক্তিদের এই মারমুখী অবস্থানে বিশ্ব পৌঁছে গিয়েছিল পারমাণবিক যুদ্ধের একদম দ্বারপ্রান্তে। অনেকেই তখন আশঙ্কা করছিলেন—এই বুঝি শুরু হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তখন চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে মরিয়া। এ কাজে তিনি গোপনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে। অথচ সেই ইয়াহিয়াই তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বাঙালিদের কণ্ঠ রোধ করতে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন, চালাচ্ছিলেন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা। নিক্সন নিজের স্বার্থে সেই গণহত্যার নায়কের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছিলেন।
সরকারি নথিপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান যে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যা চালাচ্ছিলেন, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল চীনের মন জয় করা।
তৎকালীন দ্বিমেরু বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের তখন চীনকে দরকার ছিল। আর চীনের সঙ্গে সখ্য গড়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তান কাজ করছিল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। তাই বেইজিংকে খুশি রাখতে ইয়াহিয়ার সব অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে তাঁকে সমর্থন দিয়ে যাওয়াই ছিল নিক্সনের কৌশল।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সামরিক মৈত্রীও ছিল পুরোনো। পাকিস্তান ছিল ১৯৫৪ সালের সিয়াটো (SEATO) এবং ১৯৫৫ সালের সেন্টো (CENTO) জোটের সদস্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে সমাজতন্ত্রের বিস্তার ঠেকানোই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই দুই স্নায়ুযুদ্ধকালীন জোটের লক্ষ্য। এই জোটগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করা এবং বিপদে মিত্রদের পাশে দাঁড়ানো।
বিশ্লেষকদের মতে, সে সময় নিক্সন প্রশাসনের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপও ছিল। পাকিস্তানকে রক্ষা করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্ররা ভরসা হারিয়ে ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কা ছিল ওয়াশিংটনের। তাই পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া এবং মিত্রদের কাছে নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার বার্তা পাঠানোটা নিক্সনের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সে সময় চীনের পরিস্থিতিও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের অনুকূলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাত্র কয়েক বছর আগেই সীমান্ত সংঘাতের জেরে ভারত ও চীনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ওই সময় ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সেই তিক্ততা চরম আকার ধারণ করে।
এমন প্রেক্ষাপটে ভারতকে চাপে রাখতে কৌশলগতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর করে চীন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ও পাকিস্তানের মোকাবিলায় নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে ভারতও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পোক্ত করে।
ঠিক এই সুযোগটিই কাজে লাগান নিক্সন। তিনি জানতেন, বিশ্বরাজনীতিতে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতে হলে চীনকে পাশে পাওয়া জরুরি। মজার ব্যাপার হলো, সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও চীনের সঙ্গে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ভালো ছিল না। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সাত মাসের এক অঘোষিত যুদ্ধের কারণে তাদের মধ্যেও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
সব মিলিয়ে নিক্সন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, চীনকে কাছে পাওয়ার রাস্তাটি গেছে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করতে এবং আঞ্চলিক শক্তি বাড়াতে তিনি 'পাকিস্তান কার্ড' খেলার সিদ্ধান্ত নেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাজি ধরেছিল ভারতের ওপর। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সমীকরণটিই ছিল যুদ্ধের প্রকৃত 'গেম চেঞ্জার'।
যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত নানাভাবে বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পর প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় এক কোটি মানুষকে তারা আশ্রয় দেয়। দীর্ঘ ও অরক্ষিত সীমান্তের সুযোগ নিয়ে ভারত শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েও সহায়তা করেছে।
পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে ৩ ডিসেম্বর। ভারতের উত্তরাঞ্চলে সেদিন আকস্মিক বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। ফলে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এটি ছিল দ্বিতীয় সরাসরি যুদ্ধ।
ভারত যখন পাল্টা সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে একপ্রকার বাধ্য হন। এর পেছনে সিয়াটো (SEATO) ও সেন্টো (CENTO) চুক্তির দায়বদ্ধতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার তাগিদ। কারণ, চীনের সঙ্গে যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন তখন এক ধূর্ত ছক কষেন। তিনি বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের 'টাস্কফোর্স ৭৪' পাঠানোর নির্দেশ দেন। পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী 'ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ' ছিল এই বহরের নেতৃত্বে।
নিক্সন শুধু সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি ভারতকে চাপে ফেলতে চীনকে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর অনুরোধ জানান। এমনকি রাশিয়া যদি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায়, তবে তাদের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথাও ভেবেছিলেন নিক্সন।
কিন্তু নিক্সনের কথায় নিজের বিপদ ডেকে আনতে রাজি হয়নি বেইজিং। কারণ, সোভিয়েত বাহিনী আগে থেকেই চীন সীমান্তে অবস্থান নিয়েছিল। তাছাড়া চীন বুঝে গিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করা আর সম্ভব নয়, এটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবু নিক্সন তাঁর 'গানবোট কূটনীতি' বা ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিলের চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলেন।
ভারতের 'ন্যাশনাল মেরিটাইম ফাউন্ডেশন'-এর গবেষক ও সাবেক নৌকমান্ডার রাঘবেন্দ্র মিশ্র তাঁর 'রিভিজিটিং দ্য ১৯৭১ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ অ্যাক্সিডেন্ট' গবেষণাপত্রে নিক্সনের এই পদক্ষেপের পেছনের কারণগুলো তুলে ধরেন। তিনি লিখেছিলেন, নিক্সনের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল ভারতের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা পাঠানো। এতে সম্ভাব্য নৌবাহিনী মোতায়েন এবং সীমান্ত বরাবর চীনের সামরিক পদক্ষেপও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে ভারত যুদ্ধ আর না বাড়ায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিক্সন তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে।
তবে ক্ষুব্ধ নিক্সন কোনোভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানকে ভাঙতে দিতে রাজি ছিলেন না। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাকে তিনি সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, 'ভারত যদি পশ্চিম পাকিস্তানে অভিযান চালায়, তবে অনিবার্যভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মুখোমুখি সংঘাতে জড়াবে। কারণ, ভারতের সঙ্গে সোভিয়েতদের চুক্তি আছে, আর আমাদের আছে পাকিস্তানের সঙ্গে।'
রাষ্ট্রদূতের জবাবে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিক্সন শেষমেশ বঙ্গোপসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী 'ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ' পাঠানোর নির্দেশ দেন।
১০ ডিসেম্বর ভিয়েতনামের উপকূলের 'ইয়াঙ্কি স্টেশন' ছাড়ে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ও এর সহযোগী যুদ্ধজাহাজগুলো। সিঙ্গাপুরের উত্তর-পূর্বে 'টাস্কফোর্স ৭৪' জড়ো হয় ১২ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর মালাক্কা প্রণালি পার হয়ে ১৫ ডিসেম্বর তারা পৌঁছে যায় ভারত মহাসাগরে।
পাকিস্তানের পক্ষ নিতে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চেয়েও বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিপত্র অনুসারে, ৯ ডিসেম্বর নিক্সন চেয়েছিলেন ভারত দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যেন যৌথভাবে মাঠে নামে।
সেদিন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। তাই ওই দিনই কিসিঞ্জার জাতিসংঘের চীনা স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। সেখানে তিনি মানচিত্র খুলে মার্কিন ও সোভিয়েত বাহিনীর অবস্থান দেখিয়ে সপ্তম নৌবহরের গতিপথ সম্পর্কে চীনকে অবহিত করেন।
চীন সীমান্তে সৈন্য জড়ো করতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ভারত আগেই নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে রেখেছিল। বিশেষ করে আগস্ট মাসে হেনরি কিসিঞ্জারের বেইজিং সফরের পরপরই ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে 'মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি' স্বাক্ষর করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নেয়।
পরিস্থিতি যখন জটিল আকার ধারণ করছে, তখন ১১ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী ডিপি ধরকে জরুরি বার্তা দিয়ে মস্কোয় পাঠান। ইন্দিরার সেই কূটনৈতিক চালে কাজ হয়েছিল জাদুর মতো।
আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠানোর পর চুপ করে বসে থাকেনি সোভিয়েত ইউনিয়নও। তারাও দ্রুত ভ্লাদিভোস্টক থেকে ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ারের দুটি দল পাঠিয়ে দেয়। ৬ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। এই বহরের সবচেয়ে বড় চমক ছিল পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সাবমেরিন।
সোভিয়েত নৌবাহিনী মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ওপর কড়া নজর রাখছিল। ফলে ভারতীয় নৌবাহিনী যখন পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ ও করাচি বন্দরে হামলা চালায়, তখন সপ্তম নৌবহর চাইলেও পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি। রাশিয়ার এই কৌশলী অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগরে একপ্রকার হাত-পা বাঁধা পড়ে যায় আমেরিকার।
এদিকে, চীন যাতে ভারতের ওপর হামলা চালাতে না পারে, সে জন্য বেইজিংকে কড়া বার্তা দেয় মস্কো। শুধু তা-ই নয়, চীন-সোভিয়েত সীমান্তে ৪০ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে তারা। রাশিয়ার এই বিশাল সামরিক প্রস্তুতি চীনকে ভারতের ওপর আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখে।
মস্কোর এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ভারতে নিযুক্ত তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসী। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে নাক গলাতে পারে—এমন আশঙ্কা তিনি পাত্তাই দেননি।
ভারতকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবহরও উপস্থিত আছে। তারা মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতে দেবে না।
সোভিয়েতদের কৌশল ছিল পরিষ্কার—চীন যদি ভারতের লাদাখে ঢোকার চেষ্টা করে, তবে সোভিয়েত বাহিনীও সঙ্গে সঙ্গে চীনের শিনজিয়াংয়ে পাল্টা হামলা চালাবে।
রণাঙ্গনে যখন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর তোড়জোড়, তখন কূটনৈতিক টেবিলেও পিছিয়ে ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে চীন ও অন্য মিত্রদের নিয়ে জাতিসংঘে জোর তৎপরতা শুরু করে তারা। লক্ষ্য একটাই—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে পাকিস্তানকে বাঁচানো।
৪ ডিসেম্বর থেকে নিরাপত্তা পরিষদে একের পর এক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুলতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রতিবারই বাদ সাধে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রস্তাব নস্যাৎ করে দেয়। ফলে কূটনৈতিক চাপ দিয়ে যুদ্ধ থামানোর মার্কিন কৌশল ভেস্তে যায়।
জাতিসংঘে যখন এই দড়ি টানাটানি চলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। একের পর এক শহর ও এলাকা শত্রুমুক্ত করে তাঁরা এগিয়ে যান ঢাকার দিকে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
ঢাকা থেকে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে ওয়াশিংটনে বসে সেই খবর পান রিচার্ড নিক্সন। ১৬ ডিসেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার তাঁকে জানান—পাকিস্তান হেরে গেছে, আত্মসমর্পণ করেছে।
তবে যুদ্ধ শেষ হলেও মার্কিন সপ্তম নৌবহরের তৎপরতা থামেনি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত তারা সাগরে অবস্থান করে। এরপর ফিলিপাইনের সুবিক বে-তে ফিরে যায়। গবেষক রাঘবেন্দ্র মিশ্র লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত ওই নৌবহর আর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেনি।
যুদ্ধ হয়তো শেষ হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিক্সন প্রশাসনের গোপন নথিপত্র থেকে জানা যায়, একাত্তরে দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক যুদ্ধের এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
১৯৮৫ সালের ২১ জুলাই 'টাইম' ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিক্সন নিজেই স্বীকার করেছিলেন, তিনি একাত্তরের যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, চীনের সেনারা পাকিস্তানের পক্ষে সীমান্তে নামলে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো ভারতের হয়ে যুদ্ধে নেমে পড়বে। সেই পরিস্থিতি সামলাতেই তিনি পারমাণবিক হামলার ছক কষেছিলেন।
১৯৭৩ সালে পুলিৎজারজয়ী মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন তাঁর 'দ্য অ্যান্ডারসন পেপারস' বইয়ে লিখেছিলেন, 'রিচার্ড নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জেনেবুঝেই গোপনে এসব করেছিলেন এবং মার্কিন জনগণের কাছে মিথ্যা বলেছিলেন।'
