ঢাকাসহ এশিয়ার বেশিরভাগ মেগাসিটি কেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে?
টানা সাত দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর হিসেবে টোকিওর নামই ছিল সবার মুখে। তবে জাতিসংঘের গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পাল্টে গেছে সেই হিসাব। নতুন তথ্য বলছে, টোকিওর এই রাজত্ব আরও ১৫ বছর আগেই শেষ হওয়া উচিত ছিল।
এতদিন কোনো শহরের সীমানা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সংজ্ঞাই মেনে নিত জাতিসংঘের পরিসংখ্যানবিদেরা। তবে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে শহরের প্রশাসনিক সীমানার বদলে বাস্তব বিস্তৃতি বা 'আরবান স্প্রল' বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, শহরের সীমানা ছাড়িয়ে জনবসতি বাস্তবে কত দূর ছড়িয়েছে, সেটাই এখন গণনায় ধরা হচ্ছে।
এই নতুন মাপকাঠিতে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। শহরটির বর্তমান জনসংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ, যা কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।
আবার, ৩ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে টোকিওকে পেছনে ফেলে ঢাকা উঠে এসেছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ৩ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে টোকিও এখন তৃতীয়। তালিকার শীর্ষ পাঁচের বাকি দুটি শহর হলো ভারতের দিল্লি ও চীনের সাংহাই। উভয় শহরের জনসংখ্যাই ৩ কোটির আশপাশে।
জাতিসংঘের এই পরিসংখ্যানে বিশ্বজুড়ে দ্রুত নগরায়ণের চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই শহরে (কমপক্ষে ৫০ হাজার অধিবাসী) বসবাস করে। আরও ৩৬ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামে (কমপক্ষে ৫ হাজার অধিবাসী)।
জনসংখ্যার এই উল্লম্ফন মূলত এশিয়ার মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি জনবহুল শহরের মাত্র একটি এশিয়ার বাইরের। এ ছাড়া ১ কোটির বেশি মানুষ বাস করে এমন ৩৩টি 'মেগাসিটি'র মধ্যে মাত্র ৭টি রয়েছে ধনী দেশগুলোতে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জাকার্তা ও ঢাকার জনসংখ্যায় আরও আড়াই কোটি মানুষ যুক্ত হবে, যা অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় সমান।
গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ভাগ্য বদলায়, জীবনমানে পরিবর্তন আসে। ২০২২ সালে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ওয়েটারের কাজ নেওয়া ক্লিনটন চাকমা যেমন বলছিলেন, 'ঢাকা আমার জীবন বদলে দিয়েছে, আমার সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।'
তবে এশিয়ার শহরগুলো যত বড় হচ্ছে, তত বাড়ছে জঞ্জাল, দূষণ আর অসহনীয় যানজট। নগর অর্থনীতির যে সুফল দেওয়ার কথা, তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে এসব অব্যবস্থাপনায়। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাঁ বার্তো এ বিষয়ে বলেন, 'মানুষ মূলত শ্রমবাজারের অংশ হতে শহরে আসে। কিন্তু সেই শ্রমবাজার বা শহরের ব্যবস্থা যদি ঠিকঠাক কাজ না করে, তবে শহরগুলো শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্যের ফাঁদে পরিণত হয়।'
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বাসযোগ্য শহরের তালিকায় জাকার্তা, ঢাকা ও দিল্লির অবস্থান তলানিতে। ১৭৩টি শহরের মধ্যে জাকার্তার অবস্থান ১৩২তম এবং দিল্লি ১৪৫তম। আর ঢাকার অবস্থা আরও নাজুক—তালিকায় শেষ দিক থেকে তৃতীয়। ঢাকার নিচে আছে কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক ও লিবিয়ার ত্রিপোলি।
এশিয়ার দেশগুলো যদি মধ্যম আয়ের ফাঁদ কাটাতে চায়, তবে শহরের এসব সংকট সমাধান করতেই হবে। আর এ জন্য বিচ্ছিন্ন বা জোড়াতালির কোনো প্রকল্প কাজে আসবে না; দরকার নগর শাসন ও ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার।
নগর ব্যবস্থাপনায় গলদ আসলে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বুঝতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার দিকে তাকানো যাক। বছরের পর বছর সম্প্রসারণের ফলে বোগর, দেপোক, তাংগেরাং ও বেকাসির মতো আশপাশের শহরগুলো এখন জাকার্তার পেটে ঢুকে গেছে। অথচ বিশাল এই জনপদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কানাডার সমান জনসংখ্যার একটি জনপদ চলছে যেন কোনো অভিভাবক ছাড়াই, অনেকটা হ য ব র ল অবস্থায়।
এই বিশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাশুল দিতে হচ্ছে ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়ে। বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় জাকার্তা ১২তম (এই তালিকায় ঢাকা তৃতীয় ও দিল্লি সপ্তম)।
কর্মস্থলের কাছে বাসা ভাড়া আকাশছোঁয়া, তাই বাধ্য হয়ে জাকার্তার মানুষকে থাকতে হয় দূরের উপশহরগুলোতে। গণপরিবহন ব্যবস্থাও তথৈবচ। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে মোটরবাইক বা গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যা রাস্তায় জ্যাম আর বাতাসে দূষণ—দুটোই বাড়াচ্ছে। এসবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। জাকার্তা সরকারের হিসাব মতেই, কেবল যানজটের কারণে তাদের অর্থনীতিতে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৬০০ কোটি ডলার।
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল চালু হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, শহরের প্রশাসনিক সীমানা যেখানে শেষ, মেট্রোর লাইনও সেখানে গিয়েই থেমে গেছে। অথচ ঠিক তার পরেই রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ সব উপশহর, যেখানকার মানুষের যাতায়াতের জন্য এই মেট্রোর দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি।
জাকার্তা নগর সরকারের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিভাগের প্রধান অধিক আজি এ প্রসঙ্গে বলেন, 'পুরো জোন বা বলয় মিলিয়ে সমন্বয় করাটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, তা না হলে এই ব্যবস্থার কোনো সুফল মিলবে না।' কিন্তু এই সমন্বয় হবে কীভাবে? জাকার্তা প্রশাসনের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমার সময়ে আশপাশের শহরের মেয়রদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হতো না বললেই চলে।'
এশিয়ার অন্যান্য মেগাসিটির চিত্রও কমবেশি একই। ঢাকার কথাই ধরা যাক। শহরটির আকার বাড়তে বাড়তে আশপাশের এলাকাগুলোকে গিলে খেলেও প্রশাসনিক সমন্বয়ের বালাই নেই। উল্টো ঢাকা চলছে দুই সিটি করপোরেশন, একটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং ডজনখানেক আলাদা সংস্থার অধীনে। পানি, পয়োনিষ্কাশন থেকে শুরু করে পরিবহন—একেকটি বিষয় দেখার দায়িত্ব একেক সংস্থার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, যানজট আর জলাবদ্ধতাসহ শহরের ৮০ শতাংশ সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাই তার হাতে নেই।
ভারতের পাঁচটি মেগাসিটির অবস্থাও করুণ। দিল্লির নগর দেখভালের দায়িত্ব ভাগ করা হয়েছে পৌরসভা, রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং আবাসন ও মেট্রোরেলের মতো বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর মধ্যে। আর বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিশ্বের নবম বৃহত্তম শহর কলকাতার নগর ব্যবস্থাপনায় জড়িত রয়েছে অন্তত ৪২৩টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। ভাবা যায়!
তাহলে সফল শহরগুলো চলছে কীভাবে? উদাহরণ হিসেবে চীনের সাংহাইয়ের কথা বলা যায়। সেখানে শহরটি পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, অনেকটা একটি প্রদেশের মতো করে। পরিকল্পনা থেকে পরিবহন—শহরের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে একক ও শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের হাতে। অবশ্য চীনের প্রশাসনিক মডেল আলাদা। সেখানে নেতাদের ওপর সাধারণ ভোটারের চাপ নেই, চাপ আসে বেইজিংয়ের শীর্ষ কর্তাদের কাছ থেকে। ফলে শহর পরিকল্পনায় কোনো বিশৃঙ্খলা তারা সহ্য করেন না।
জাপানের টোকিও শহরকে একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। সেখানে 'টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট' বা মহানগর সরকার পানি, পয়োনিষ্কাশন ও সরকারি হাসপাতালের মতো বড় ও জরুরি সেবাগুলোর দায়িত্ব পালন করে। এই কাঠামোর নিচেই রয়েছে ২৩টি ওয়ার্ড এবং আশপাশের ছোট ছোট শহর।
প্রতিটি পৌরসভার নিজস্ব নির্বাচিত মেয়র ও পরিষদ আছে। তারা স্কুল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় পরিকল্পনার বিষয়গুলো দেখভাল করে। আর মহানগর সরকার তাদের সবার মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। কাজের এমন চমৎকার ভাগাভাগি থাকায় কার কী দায়িত্ব, তা নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা থাকে না, সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হয়।
এশিয়ার অন্য মেগাসিটিগুলোর মতো টোকিও সংলগ্ন কানাগাওয়া, শিবা বা সাইতামার মতো এলাকাগুলোও আলাদা আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন। তবে জাপানের কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করে। সেই সঙ্গে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা মেট্রোরেল ও কমিউটার ট্রেনের নেটওয়ার্ক পুরো অঞ্চলকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। বৃহত্তর টোকিওর ৯০ শতাংশ মানুষই রেলস্টেশন থেকে মাত্র ২০ মিনিটের হাঁটা-দূরত্বে বসবাস করে।
অবশ্যই টোকিওর আর্থিক সচ্ছলতা এখানে একটি বড় সুবিধা। ১৯৬৫ সালে টোকিওর জনসংখ্যা যখন ২ কোটি, তখন জাপানিদের মাথাপিছু আয় ছিল সাড়ে ৯ হাজার ডলার (২০১১ সালের হিসেবে)। অথচ ২০০৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা যখন ২ কোটিতে পৌঁছায়, তখন বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১ হাজার ৯০০ ডলার।
তবে জাকার্তা, ঢাকা কিংবা দিল্লির মতো শহরগুলোকে বাসযোগ্য করতে এখনই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের চেয়ে বেশি জরুরি প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার। অবকাঠামোতে দেদার টাকা খরচে যতটা সহজে চমক দেখানো যায়, প্রশাসনিক ক্ষমতার কাঠামো বদলানো তার চেয়ে অনেক কঠিন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এশিয়ার মেগাসিটিগুলোর জন্য এই কঠিন কাজটিই এখন সবচেয়ে জরুরি। এর সুফলও হবে সুদূরপ্রসারী।
