১৯৭১ সালে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করে যে ইতিহাস গড়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট জর্জ হ্যারিসন 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' আয়োজন করে ইতিহাস রচনা করেন। এই কনসার্টে দুইটি শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা ভবিষ্যতে সংগীতভিত্তিক দাতব্য কার্যক্রমের নতুন ধারা সৃষ্টি করে। হ্যারিসন বিশ্বখ্যাত সেঁতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে মিলে এই আয়োজন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। এর পেছনে মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ।
পুরো আয়োজনটা নিখুঁত না হলেও আকারে বিশাল ছিল, পুলিশি তৎপরতা প্রায় ছিল না। পাশাপাশি, একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অনেক তারকা, যা বিবেচনায় এটি ছিল সফল এক উদ্যোগ।
১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসনের ঐতিহাসিক প্রয়াস
বিটলস ভেঙে যাওয়ার মাত্র দুই বছর পর জর্জ হ্যারিসন এমন এক প্রকল্প হাতে নেন, যা বিটলসের অন্য কেউ আগের মতো করেননি। তার বন্ধু ও সহশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রথমে তহবিল সংগ্রহের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করেন। হ্যারিসন সেই পরিকল্পনাকে আরও বড় আকারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রবিশঙ্করের লক্ষ্য ছিল ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধকালীন গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের জন্য অন্তত ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করা।
তৎকালীন সময় হ্যারিসন আর বিটলসের সদস্য না হলেও অ্যাপল কর্পস-এর সুযোগ-সুবিধা বন্ধুর প্রয়োজনে কাজে লাগান তিনি। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে দুই দফায় কনসার্ট করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর হ্যারিসন একে একে শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।

হ্যারিসনের ভাগ্যও ভালো ছিল। বেশিরভাগ শিল্পী সহজেই রাজি হন। রিংগো স্টার, বিলি প্রেস্টন, ব্যাডফিঙ্গার, এরিক ক্ল্যাপটন ও লিয়ন রাসেল প্রথমেই অংশগ্রহণের অনুমতি দেন।
তবে সবার সঙ্গে বিষয়টি এত সহজ ছিল না। জন লেনন এবং পল ম্যাককার্টনি কেউ অংশ নেননি, তবে তাদের প্রত্যাখ্যানের কারণ আলাদা ছিল। বব ডিলানকে নিয়ে প্রথমে দ্বিধা ছিল, কিন্তু হ্যারিসন তাকে বোঝান এবং নিজের অস্থিরতা সম্পর্কেও কথা বলেন। ডিলানের একক পারফর্মেন্সের অভিজ্ঞতাকে এ বিষয়ে সুবিধা হিসেবে উল্লেখ করেন।
এরিক ক্ল্যাপটনও ব্যক্তিগত জটিলতার মধ্যে ছিলেন। হেরোইনের পুরোনো আসক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়েছিল তার মধ্যে। তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি মঞ্চে উঠে অংশ নেন।
'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'–এর অভূতপূর্ব সাফল্য
বিটলস ছাড়ার পর জর্জ হ্যারিসনের জন্য এটি ছিল এক নতুন চ্যালেঞ্জ—নিজ উদ্যোগে একটি সফল তহবিল সংগ্রহের কনসার্ট আয়োজন করা। বন্ধু রবিশঙ্কর ও যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশিদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই এই উদ্যোগ। নিজের ওপর প্রচণ্ড চাপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন হ্যারিসন, তবে দুশ্চিন্তা বেশিদিন টেকেনি।
কনসার্টটি ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং ভাস্কর্য সফল হয়। রবিশঙ্করের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার ডলার তোলা। কিন্তু টিকিট বিক্রি থেকেই সংগ্রহ হয় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার অনেক গুণ বেশি।

এরপর 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর লাইভ পারফরম্যান্সের তিনটি ভিনাইল ডিস্কের একটি বক্স সেট প্রকাশ করে আরও অর্থ সংগ্রহ করা হয়। যদিও ট্যাক্সজনিত জটিলতার কারণে অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের কাছে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল, তবুও শেষ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ডলার সংগ্রহ সম্ভব হয়। এ ধরনের আয়োজনের ইতিহাসে এত বিশাল সাফল্য প্রথমবারেই দেখার মতো ছিল।
জর্জ হ্যারিসনের জন্য এটি শুধু সংগীতজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল না, শিল্পীদের দাতব্য কার্যক্রমের ধারা বদলে দেয় এই কনসার্ট। এর অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে 'লাইভ এইড', 'ফার্ম এইড', 'লাইভ এইট'-এর মতো বড় দাতব্য কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়।
হ্যারিসনের প্রয়াস ছিল তার ব্যক্তিগত খ্যাতির চেয়েও অনেক বড়। এতে তার অহংকার বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কোনো স্থান ছিল না। কারণ তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি 'উইদিন ইউ উইদাউট ইউ' এবং 'আই, মি, মাইন'-এর মতো অহংকারবিহীন গান রচনা করেছিলেন।