ভায়োলিন শিখতে আট ঘণ্টার দীর্ঘপথ পাড়ি দিতেন তিনি, এখন কোল্ডপ্লের সঙ্গে এক মঞ্চে
জেট ল্যাগ হোক কিংবা দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি, এসব নিয়ে কখনোই ভাবতে হয় না ভেনিজুয়েলার পাথ্রিসিয়া মেন্ডোনকাকে।
২৬ বছর বয়সী এই বেহালাশিল্পী সম্প্রতি উড়ে এসেছেন লন্ডনে। এখানে বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড কোল্ডপ্লের সঙ্গে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে টানা ১০টি কনসার্টে অংশ নেবেন তিনি। ভেনিজুয়েলার সিমন বলিভার সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার একজন সদস্য হিসেবেই এই সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
যাত্রাটি ছিল ১২ ঘণ্টার। পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে মাত্র ১০ মাস বয়সী প্রিয় কন্যাসন্তানকে, রেখে এসেছেন মায়ের কাছে। তবুও উত্তর লন্ডনের বিখ্যাত এয়ার স্টুডিওতে যখন তিনি রিহার্সালের জন্য এলেন, তার মধ্যে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই, বরং তিনি প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
এই অফুরন্ত প্রাণশক্তির কারণ সম্ভবত লুকিয়ে আছে তার অতীতে। যখন তার বয়স মাত্র ১২, তখন ভেনিজুয়েলায় ভায়োলিনের ক্লাস নিতে তাকে প্রায়ই সারারাত জেগে দীর্ঘ বাসযাত্রা করতে হতো। কেবল কারাকাসে ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্যই এই কষ্ট সহ্য করতেন তিনি।
নিজের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে পাথ্রিসিয়া বলেন, 'আমি বারকুইসিমেতোর মেয়ে, ছোট্ট একটা শহর। সেখান থেকে বাসে (রাজধানী কারাকাসে) যেতে আট ঘণ্টা লেগে যেত, কারণ বাসগুলো খুব ধীরে চলত।প্রতি সপ্তাহেই আমাকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো।'
তিনি বলেন, 'আমার কাছে মনে হয়, আজকের এই অর্কেস্ট্রার অংশ হওয়ার পেছনে সেই পরিশ্রমই ছিল মূল চাবিকাঠি।'
ঘুম বা বিশ্রামের অভাব তার কাছে কোনো বড় বিষয়ই নয়।
মেন্ডোনকার সঙ্গে কথা বললে যে কেউ নিজেকে সামান্য ভাবতে পারেন। বিশ্ববিখ্যাত এই অর্কেস্ট্রায় ভায়োলিন বাজানোর পাশাপাশি তিনি একজন শিক্ষক, একজন মা এবং একজন শেফ। সম্প্রতি তিনি সংগীতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও সম্পন্ন করেছেন।
তবে আগামী তিনটি সপ্তাহ বিশ্বের অন্য কোথাও থাকার কথা তিনি ভাবতেও চান না।
লাজুক হেসে তিনি বলেন, 'জানি না এটা বলা ঠিক হবে কি না, কিন্তু আমি কোল্ডপ্লের একজন পাগল ভক্ত। তাই যখন আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো, 'তুমি কি এসে বাজাতে চাও?', আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, 'এও কী সম্ভব!'
'যখনই আমি বাড়িতে বসে ব্যান্ডটির গান শুনতাম, আমি সবসময় 'ভিভা লা ভিদা' গানটি বাজানোর স্বপ্ন দেখতাম। গানটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্ট্রিংয়ের ব্যবহার রয়েছে। তাই আমার জন্য এটা একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। পুরোটাই স্বপ্নের মতো লাগছে।'
সিমন বলিভার সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার অন্য বাদকদের মতো মেন্ডোনকাও ভেনিজুয়েলার বিখ্যাত 'এল সিস্তেমা' কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। এই প্রকল্পের আওতায় দেশজুড়ে বিনামূল্যে সংগীত শিক্ষা দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালে দূরদর্শী সংগীতজ্ঞ হোসে আন্তোনিও আব্রেউ এই প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার লক্ষ্য ছিল, দেশটিকে গ্রাস করা অপরাধ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগীতকে ব্যবহার করা।
গত পাঁচ দশকে ত্রিশ লাখেরও বেশি শিশু 'এল সিস্তেমা' কর্মসূচির মাধ্যমে সংগীত শিক্ষা পেয়েছে এবং বিশ্বের কয়েক ডজন দেশে এই মডেলটি অনুসরণ করা হয়েছে।
আগামী তিন সপ্তাহে ওয়েম্বলির মঞ্চে প্রায় দশ লাখ মানুষ তাদের এই সাফল্যেরই সাক্ষী হবে।
এই বিশাল দর্শক সংখ্যার কথা ভেবে মেন্ডোনকা বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, 'আমি এর আগে কখনো এত মানুষের সামনে বাজাইনি। আমার জন্য এটি অনেক বড় ব্যাপার।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি সুযোগ। আর ব্যক্তিগতভাবে, আমি যে শিশুদের পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি, তাদেরও মনে আশা জাগানোর একটি উপায়।'
