অপেশাদার বক্সিংয়ে হিজাবের অধিকার এনে এবার হিজাব পরে পেশাদার রিংয়ে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন জেইনা নাসসার
বার্লিনের বসার ঘরে বাবা-মায়ের সামনে একগাদা নোটের এক বিশাল স্তূপ নিয়ে বসলেন জেইনা নাসসার। উদ্দেশ্য, বেশকিছু যুক্তি সাজিয়ে তাদের সামনে একটি 'প্রেজেন্টেশন' দেওয়া—কেন তাদের তাকে বক্সিংয়ের অনুমতি দেয়া উচিত!
তখন তার বয়স মোটে ১৩। ইউটিউবে নারী বক্সারদের অনুশীলনের ভিডিও নিয়মিত দেখতে দেখতেই বক্সিংয়ের প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করতে শুরু করেন তিনি। প্যাডে আঘাতের ছন্দ, ঘুষির তীক্ষ্ণ শব্দ আর প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে যে শক্তি—সবকিছুই যেন চুম্বকের মতো টেনে নিয়েছিল তাকে।
'ভিডিওগুলো আমি বারবার দেখতাম। আমি জানতাম, এটিই আমার গন্তব্য, আমি এটিই করতে চাই,' বলেন ২৭ বছর বয়সী জেইনা।
সেই বয়সেই, ছোট এক আইনজীবীর মতো নিজের ভবিষ্যতের সপক্ষে জোরালো সব যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তিনি। 'আমি আমার বাবা-মাকে বলেছিলাম, বক্সিং হলো মূলত শ্রদ্ধা আর শৃঙ্খলার বিষয়। তাই আমাকে অনুমতি দিলে স্কুলে আমার মনোযোগ বাড়বে, আমি শুধু মেয়েদের জন্য খোলা কাছের একটি জিমে যাব,' বলেন তিনি।
নাসসারের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি শুনে বাবা-মা মুগ্ধ তো হয়েছিলেনই, কিন্তু তাদের রাজি করানোটা ছিল পুরো পথের সহজতম অংশটুকু মাত্র।
জার্মানিতে জন্ম হলেও তার পূর্বপুরুষের ভিটে লেবাননে। একজন মুসলিম কিশোরী হিসেবে গর্বের সঙ্গে হিজাব পরতেন জেইনা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন, তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের জগতে অপেক্ষা করছে।
তিনি স্থানীয় একটি বক্সিং জিমে যোগ দিলেন। কিন্তু সেই সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিযোগিতায় হিজাব পরে অংশ নেওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই রিংয়ে নামার অধিকার পেতে তাকে লড়াইয়ে নামতে হলো।
'লোকেরা বলত, আমাকে হয় হিজাব, না হয় বক্সিং—যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। আমি ভাবতাম, আমাকে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে? আমি তো কারও কোনো ক্ষতি করছি না। আমি শুধু বক্সিং করতে চাই।'
হিজাব ও পুরো শরীর ঢাকা পোশাকে পাকিস্তানে পেশাদার বক্সিংয়ে অভিষেক হতে যাচ্ছে জেইনার। তার প্রশিক্ষক ও পরামর্শদাতা হিসেবে থাকবেন কিংবদন্তি রয় জোনস জুনিয়র।
পেশাদার নারী বক্সিংয়ে হিজাব পরে অংশ নেওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য আর কোনো উদাহরণ জানা নেই। তাই মনে করা হচ্ছে, জেইনাই সম্ভবত প্রথম। ফলে তার এই অভিষেক আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে নাসসার জার্মান অপেশাদার বক্সিংয়ের নিয়ম বদলে দিতে সাহায্য করলেন, যাতে তিনি লম্বা হাতা ও মাথা ঢাকার পোশাক পরে প্রতিযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু যখন তিনি তার প্রথম অপেশাদার লড়াইয়ের জন্য রিংয়ের দড়ির ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকলেন, তিনি অনুভব করতে পারছিলেন সবার দৃষ্টি তার দিকেই।
'আমি বুঝতে পারছিলাম বহু মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ তো আমাকে বলেছিল যে আমি এভাবে লড়তে পারব না। আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারতাম না—এটা তো আমার পারফরম্যান্স এবং রিংয়ে আমি কতটা ভালো, সেটা নিয়ে হওয়া উচিত। অথচ বহু মানুষ এর বিপক্ষে ছিল,' বলেন তিনি।
তবে রিংয়ে নিজের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স দিয়ে সবার মনোভাব পাল্টে দিলেন জেইনা। একের পর এক বার্লিন চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন, জাতীয় শিরোপাও জয় করলেন, আর এই পুরোটা সময় নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থাকলেন।
কিন্তু যখন ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ) তাকে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আমন্ত্রণ জানাল, তখন তিনি আরেকটি নতুন বাধার মুখে পড়লেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তখনও হিজাব নিষিদ্ধ ছিল।
তাই ১৯ বছর বয়সে তিনি বৈশ্বিক স্তরে এই নিয়ম পরিবর্তনের জন্য প্রচার শুরু করলেন।
'জার্মানি থেকে আমি কোনও সমর্থন পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি আশাবাদী ছিলাম। অন্য সব অ্যাথলেটের মতো একই ধরনের ন্যায্য আচরণ চেয়েছিলাম আমি,' বলেন তিনি।
অবশেষে, ২০১৯ সালে আইবিএ হিজাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বর্তমানে অলিম্পিক বক্সিং পরিচালনা করে 'ওয়ার্ল্ড বক্সিং' সংস্থা, যারা হিজাব ও পুরো শরীর আবৃত করার পোশাকের অনুমতি দেয়।
জেইনা বলেন, 'আমার জন্যই এখন অপেশাদার বক্সিংয়ের প্রত্যেক নারী হিজাব পরে লড়তে পারে এবং নিজেদের মতো করে থাকতে পারে। এটাই আমার সবচেয়ে গর্বের জয়।'
কিন্তু পেশাদার বক্সিংয়ে কী হবে? সেখানকার নিয়মই বা কী? হিজাব কি বিপজ্জনক হতে পারে? না কি এটি কোনো বিশেষ সুবিধা এনে দেবে?
দেখা যায়, ওয়ার্ল্ড বক্সিং অর্গানাইজেশন (ডব্লিউবিও) পোশাক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত স্থানীয় কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং ফেডারেশন (আইবিএফ)-এ ধর্মীয় টুপি বা মাথা ঢাকার পোশাক নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে, ইউকে-তে পেশাদার বক্সিং পরিচালনাকারী সংস্থা ব্রিটিশ বক্সিং বোর্ড অফ কন্ট্রোল খেলাধুলার জন্য তৈরি হিজাবের অনুমতি দেয়।
তবে জার্মান বক্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট অলিভার উইটম্যান স্বীকার করেন যে এ ব্যাপারে নজির খুবই কম। একই সঙ্গে এর নিরাপত্তা এবং লড়াইয়ের মাঝখানে হিজাব খুলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
উইটম্যানের মন্তব্যের জবাবে জেইনা বলেন, 'প্রায় ১০০টি অপেশাদার লড়াইয়ে এটি কখনও কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি।' টিম জিবি-র মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করা অধ্যাপক মাইক লুসমোর বলেন, 'এটি কোনো সমস্যাই না।'
তিনি আরও বলেন, 'হিজাব হালকা, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যায় এমন কাপড় দিয়ে তৈরি। হিজাব পরে বক্সিং করলে আমার কোনো সমস্যা নেই। এগুলো নিরাপদ। বক্সার বা প্রতিপক্ষের জন্য এগুলো কোনো সমস্যা তৈরি করে না।'
সাধারণত আন্তর্জাতিক বক্সিং ইভেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানের নাম সেভাবে যুক্ত হয় না। তবে পেশাদার বক্সিংয়ের চার দিনব্যাপী এই লড়াই দেখতে লাহোরে ২০ হাজার এরও বেশি দর্শক সমাগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাঞ্জাব সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এই শোতে ব্রিটিশ বক্সার অ্যালেক্স দিলমাঘানি, জিমি কেলি ও জেমস মেটকাফসহ দেশি-বিদেশি বক্সারদের দেখা যাবে।
এই ইভেন্টের মূল উদ্যোক্তা লিভারপুলের ক্রিস গ্লোভার যোগ করেন, 'বক্সিং সবার জন্য। জেইনা যদি হিজাব পরতে চায়, সে চাইলে একটা কাউবয় টুপিও পরতে পারে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সে একজন অগ্রদূত।'
