চেসবক্সিং: যে খেলায় শুধু বক্সিং নয়, দাবাতেও হতে হবে তুখোড়

চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে বক্সিং রিং, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি, রেফারিও হাজির। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধের বদলে তারা বসে আছেন দাবার বোর্ড নিয়ে!
দেখলে প্রথম প্রথম একটু বিভ্রান্তি হতে পারে। ঘামে ভেজা শরীরে যেখানে একে অপরকে একেবারে কিল-ঘুষি দিয়ে লড়াই জেতার চেষ্টার কথা, সেখানে তারা বক্সিং রিং-এ চেষ্টা করছেন দাবা খেলায় হারানোর? এ আবার কেমন খেলা!
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎই টেবিল-চেয়ার সরে যাবে, প্রতিপক্ষদের হাতে উঠে আসবে বক্সিং গ্লাভস। সেই দাবার আসরেই তখন শুরু হবে পাঞ্চের লড়াই।
খেলাধুলার দুনিয়ার এই নতুন মোড়ের নাম—'চেসবক্সিং'। অনেকেই এটিকে 'দাবাবক্সিং' হিসেবেও চেনেন। এখানে বুদ্ধি আর শক্তির লড়াই চলে সমানতালে। দাবার চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিতে হবে বক্সিংয়ের ঘুষি। তবে আমাদের মতো ক্রিকেট-ফুটবলপ্রিয় দেশে চেসবক্সিং এখনও বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অপরিচিত।
লন্ডনের স্কালা নাইটক্লাবে মে মাসের ঘটনা। হামজা বুহারি আগামী তিন মিনিটের মধ্যে প্রতিপক্ষকে বক্সিংয়ে নকআউট না করলে দাবায় নিজের 'রাজা' হারাতে হবে। লন্ডনের ২৮ বছর বয়সী ফার্মাসিস্ট বুহারি লড়ছেন লিথুয়ানিয়ার তাদাস চেপোনিসের বিপক্ষে।
তৃতীয় রাউন্ডের ঘণ্টা বাজার পর বোঝা যাচ্ছিল, বুহারি হারের একদম কাছাকাছি। তখন তিনি হুট করে আক্রমণাত্মক হয়ে দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক ঘুষি। চেপোনিস তা আর সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলে, রেফারি লড়াই থামিয়ে বিজয়ী ঘোষণা করেন বুহারিকে।
প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আলিঙ্গন করে ৫০০ জনের মতো দর্শকের সামনে চেপোনিস বলেন, 'ওর (বুহারি) বক্সিং অনেক ভালো, আজ সেটা টের পেয়েছি।'
জবাবে বুহারি বলেন, 'সে (চেপোনিস) দাবাবোর্ডে দুর্দান্ত।'
চেসবক্সিং এর নিয়মিত দর্শকদের মতে, শুধু বক্সিং বা দাবার চেয়ে এই চেসবক্সিং আরও অনেক বেশি মজার।
এই খেলার নিয়ম সম্পর্কেও একটু জানা যাক । সাধারণত খেলাটি হয় মোট ১১ রাউন্ডে । চার মিনিটের দাবা রাউন্ডের পর শুরু হয় তিন মিনিটের বক্সিং। এই দুই রাউন্ডের মধ্যে এক মিনিট বিরতি দেওয়া হয় ।
তাছাড়া, এখানে দাবা খেলাটি অনেকটা স্পিড দাবার মতো—প্রতিটি প্রতিযোগীর কাছে পুরো গেমের জন্য মোট বারো মিনিট সময় থাকে।
প্রতিযোগীরা নক-আউট, চেকমেট, বিচারকের সিদ্ধান্ত অথবা প্রতিপক্ষের দাবার ১২ মিনিট সময় শেষ হয়ে গেলে জিতে যান।
দুটি খেলা মিলিয়ে যে খেলোয়াড়ের পয়েন্ট বেশি হয়, তিনিই জয়ী হন।
চেসবক্সিং-এর ধারণার উৎস ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জোসেফ কুওর কুংফু চলচ্চিত্র 'মিস্ট্রি অফ চেসবক্সিং'-থেকে। এরপর দাবা আর বক্সিংকে একসঙ্গে মেলানোর ধারণাটি আসে ডাচ শিল্পী ইয়েপে রুবিং এর মাথায়।
রুবিং মূলত ১৯৯২ সালের ফরাসি কমিক শিল্পী এনকি বিলালের কমিক 'ফ্রয়েড ইকুয়েটুর' থেকে অনুপ্রাণিত হন। সেই কমিকে চেসবক্সিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের কাহিনি দেখানো হয়। যদিও কমিকে প্রতিপক্ষরা পুরো বক্সিং ম্যাচ শেষ করার পর দাবার বোর্ডে বসে, তবে রুবিংহ এটিকে বাস্তবসম্মত মনে করেননি।
তাই তিনি নিজের মতো করে এটিকে আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। ধাপে ধাপে গড়ে তোলেন আজকের প্রতিযোগিতামূলক চেসবক্সিং, যেখানে দাবা আর বক্সিংয়ের রাউন্ডগুলো চলে পরপর এবং নিয়মাবলিও সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত।
প্রথম চেসবক্সিং লড়াই হয়েছিল ২০০৩ সালে বার্লিনে। এটি আয়োজনও করেছিলেন রুবিং।
পাঁচ বছর পর, যুক্তরাজ্যে এক ভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে আবারও নতুন উদ্যমে শুরু হয় এই খেলা। করোনার সময় অনলাইনে দাবা খেলার জনপ্রিয়তা ও জনপ্রিয় টিভি সিরিজ 'দ্য কুইন'স গ্যাম্বিট'-এর প্রভাবে ক্রমেই চেসবক্সিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
চেসবক্সারের প্রচারক গ্যাভিন প্যাটারসনের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চেসবক্সিং লড়াই হয়েছে যুক্তরাজ্যে। এখানেই রয়েছেন প্রায় ২০০ জনের মতো নিয়মিত চেসবক্সার।
সেই সাথে যুক্তরাজ্যই প্রথম চেসবক্সিং গ্রেডিং ব্যবস্থা চালু করে—যেটা অনেকটা জুডো বা কারাটের বেল্টের মতো। প্যাটারসন বলেন, 'ব্রিটিশ চেসবক্সিং অনেক বেশি সফল, কারণ তারা বক্সিং আর রেসলিং থেকে উপস্থাপনার কৌশল রপ্ত করেছে।'
স্কালা নাইটক্লাবে বুহারি-চেপোনিসের সেই লড়াইয়ের ঠিক আগের শনিবার সকালে এক ডজন চেসবক্সার জড়ো হন লন্ডনের ইস্লিংটন বক্সিং ক্লাবে—এটি যুক্তরাজ্যে চেসবক্সিংয়ের মূল কেন্দ্র।
সেখানে বক্সিং রিংয়ের পাশে চারটি দাবাবোর্ড বসানো। প্রশিক্ষণ চলে ধাপে ধাপে—এক রাউন্ড দাবা, পরের রাউন্ডে কঠোর ব্যায়াম বা স্প্যারিং। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—একদিকে দম আটকিয়ে মস্তিষ্কের খেলা চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে শ্বাস নিতেই হিমশিম খাওয়া।
প্রচণ্ড হৃদস্পন্দন কিংবা মাথা বরাবর প্রতিপক্ষের এক-দুটি ঘুষিই হুঁশ উড়িয়ে দিতে পারে। তাই প্রশিক্ষণে শেখানো হয়, পরবর্তী বক্সিং রাউন্ড শুরুর ঠিক আগে দাবায় চাল দিয়ে ফেরা, যাতে ফিরে এলে প্রতিপক্ষের ঘড়ি চলতে থাকে। ম্যাচের ভাগ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এই দাবা বোর্ডেই নির্ধারিত হয়ে যায়।
প্যাটারসন বলেন, 'এ খেলায় বক্সিং যেভাবে দাবার ওপর প্রভাব ফেলে, দাবাও ঠিক একইভাবে প্রভাব ফেলে বক্সিংয়ে।'
বিশ্বের মোট ১৬টি দেশে চেসবক্সিং খেলা হয়। এরই মধ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশেও চেসবক্সিং খেলার প্রচলন দেখা যায়।
তবে চেসবক্সিং এখনও অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত নয় । ২৪টি দেশে খেলার প্রচলন থাকলে তবেই অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে ।
যদিও এশিয়ায় এখনও চেসবক্সিং-এর তেমন জনপ্রিয়তা দেখা যায়নি। দাবার প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত রাশিয়ায় এই খেলার প্রচলন থাকলেও, দাবার জন্মভূমি ভারতে এই খেলার প্রচার নেই বললেই চলে। বাংলাদেশেও চেসবক্সিং নিয়ে মানুষের খুব একটা ধারণা নেই।
এ ধরনের খেলায় মূলত যোগ দেন তাঁরা, যারা 'রেনেসাঁ' বা সর্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চান, কিংবা যারা 'নার্ডি' বা অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে চান।
মিশরের গ্র্যান্ডমাস্টার সামি শোকার, যিনি বিশ্বে সক্রিয় চেসবক্সারদের মধ্যে শীর্ষ ১,০০০-এর মধ্যে রয়েছেন, স্কালায় চেসবক্সিং এ জার্মানির আন্দ্রে গ্লেনজারকে হারিয়ে ডাব্লিউসিবিএ ইউরোপীয় মিডলওয়েট শিরোপা জিতেছেন।
চেসবক্সিংয়ের অভিষেকের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শারীরিক অবস্থাও উন্নত হয়েছে, জানান ৩৭ বছর বয়সী শোকার, যিনি 'ফারাওদের মুকুট' পরে রিংয়ে প্রবেশ করেছিলেন।
তবে এই খেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিংয়ে নামা প্রতিযোগীরা অর্থের লোভে আসেন না। স্কালায় কোনো আর্থিক পুরস্কারই দেওয়া হয়নি। অথচ কয়েক সপ্তাহ পরই আসন্ন দাবা প্রতিযোগিতা ফিদে ওয়ার্ল্ড র্যাপিড অ্যান্ড ব্লিটজ টিম চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬৫ হাজার ডলার।
ব্যাপারটা অনেকটা স্কালায় চেসবক্সিং-এর এক স্বেচ্ছাসেবকের কথার মতো, 'চেসবক্সিং চলে গর্ব আর বোকামির জোরে!'